সব গ্রন্থই পবিত্র
সাহিত্য২: আমার বাবা বুদ্ধদেব বসু সাহিত্য৩: কালীকৃষ্ণ গুহ'র কবিতা সাহিত্য৪: কবিতা ও গল্প সাহিত্য৬: কবিতা সাহিত্য৮: কবিতা সাহিত্য১৩: কাব্যালোচনা সাহিত্য১৪: কাজী ফয়সল আহমেদ-এর কবিতা সাহিত্য২২: তিন প্রকার ছন্দ সাহিত্য২৩: ক্যাফের কবিতা সাহিত্য২৪: কবিতা সংবাদ সাহিত্য২৫: আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব সাহিত্য২৭: সভ্যতায় নারী: অনাদৃত অবদান--পূরবী বসু |
সাহিত্য/গল্প
পিপাসাহাসানআল আব্দুল্লাহ
নিজের সাথে এই যুদ্ধ আর কতোকাল, আর কতোকাল নিয়ন্ত্রিত ভাগ্যের কাছে এমনভাবে সমর্পিত হয়ে জবুথবু জীবন কাটিয়ে দেবেন, সময় ও সময়হীনতার চারপাশে চরকির মতো ঘুরে ঘুরে তিলেতিলে শেষ হয়ে যাবেন, মাথা নিচু করে চেয়ারে পা দোলাতে দোলাতে ভাবেন তিনি। যদিও মাঝে মাঝে প্রশ্ন ওঠে, নিজের মনে, এমন করে সমাজ ও সভ্যতাকে ঠকিয়ে কি লাভ! কিন্তু ঠকানোর যে প্রক্রিয়া একদিন চালু করেছিলেন নিজেই, যে আশা নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছিলেন, সেই আশা যেহেতু পূরণ হবার নয়, বিম্বিত স্মৃতির কিনারে দাঁড়িয়ে সেই সত্য যদিও প্রকাশযোগ্য নয়, তাই মিথ্যার উপর ভর করে দিনদিন এমন একটা জায়গায় এসে পড়েছেন যে এখন অজান্তে নিজেকেই অকাতরে ঠকিয়ে যাচ্ছেন। কেউ এখন তার খোঁজ খবর নেবার জন্যে গদ্যেপদ্যে ভাষা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। মাঝে মাঝে লিভিং রুমের ফোনের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সময়কে মরে যেতে দেন, কিন্তু এই দুরূহ দুর্দান্ত সময় অতো সহজে মরেও যেতে চায় না; মনে হয় ফোন যদি একবার বেজে ওঠে! অবশ্য আজকাল এই যন্ত্রটাও শব্দ করা ভুলে গেছে। একটু আধটু বাজলেও কলার আইডি দেখে বুঝে নেয়া যায় যে ওটা কোনো কম্পানির টেলিমার্কেটিং। অতএব ধরার আগ্রহ থাকে না। তারপরও অন্তত সময় কাটানোর জন্যে কখনো সখনো ধরেন, ওদের কথার উত্তর দেন; কিন্তু নানা রকম প্রশ্নের সামনে বিরক্ত হয়ে বকাবকি করে ফোন ছাড়েন। ডোন্ট কল মি এগেইন জাতীয় বাক্যও বেরিয়ে আসে দড়াম করে ফোন রাখার সাথে সাথে। তারপর চলে উচ্চস্বরে বকাবকি, যার ভাষাও নিয়ন্ত্রিত নয়, যেমন, শুয়োরের বাচ্চাগুলোর খেয়ে দেয়ে তেমন কোনো কাজ নেই, শুধু মানুষদের বিরক্ত করা; হারামির বাচ্চাগুলো সেজেগুজে সজ্জিত টেবিলের সামনে ফোন নিয়ে বসে থাকে, তারপর একের পর এক ফোন করে যায়, মাদার ফাকার, আনসিভিলাইজড, আনকোথ, ইগনরেন্ট, বিচ, ইত্যাদি। একবার তো এমন হলো যে তিনিই উল্টে ফোনকারীকে বলে বসলেন তার নিজস্ব নাম্বার দিতে, বললেন, “গিভ মি ইয়োর সেল ফোন নাম্বার, নো নো গিভ মি ইয়োর হোম ফোন নাম্বার।” ওপাশ থেকে শোনা গেলো, “মেম, আই এম নট সাপোসড টু গিভ ইউ মাই সেল অর হোম ফোন নাম্বার, ইউ মে রাইট ডাউন দ্যা কম্পানি নাম্বার।” এর পর ওয়ান এইটহানড্রেড ডট ডট ডট একটি নাম্বার মুখস্ত বলে গেলো। কিন্তু তিনি আরো উত্তেজিত হয়ে বললেন, “তুমি তো আমার বাসার নাম্বারেই ফোন করেছো, আমাকে বিরক্ত করছো, আমি কেনো তোমার বাসার বা মুঠোফোনে ফোন করতে পারবো না! আমি দিনে কয়েকবার ফোন দেই, দেখবে তোমার কেমন লাগে!” ওপাশ থেকে আর কথা বাড়ে না, উই আর সরি ফর ইয়োর ইনকনভিনিয়েন্স বলে ফোন ছেড়ে দেয়। মাজেদা খাতুন তাঁর স্বামীকে নিয়ম মাফিক তালাক দিয়েই নিউইয়র্কে এসেছিলেন। অবশ্য তার আগে একজন সুদর্শন মার্কিনী ইঞ্জিনিয়ারের প্রেমে পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে তিনি নতুন দেশে এসে নতুন একটি ঘর বাঁধবেন। পিস কোরে জাতিসঙ্ঘের ভলেনটিয়ার সার্ভিসে বাংলাদেশে গেলে ঢাকায় ওই সুদর্শনের সাথে তার পরিচয়, সেখান থেকে আস্তে আস্তে প্রণয় এবং যথারীতি হিসেব মতো সবই হয়ে যায়। কিন্তু সব হিসেব তো আর সব দিন একই রকম থাকে না। সুদর্শনের সাথে পনেরো বছর সংসার করার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে নিঃসন্তান মাজেদা একেবারে একা হয়ে যান। সেও প্রায় বছর দশেক আগের কথা। এখন তার সেই একাকী জীবনে সঙ্গী বলতে ছোটোখাটো একটা বুলডগের তিন বছরের বাচ্চা, যে মাজেদার চেয়েও রাগি, ক্ষিপ্র, বিচক্ষণ। কুকুরটির নাম জেদা। নিজের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছিলেন এই নাম। ওর বয়স যখন বছরখানেক তখন আমেরিকান এক পরিবার থেকে ধরতে গেলে বিনা পয়সায়ই পেয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে মাজেদা ফোন করে ওদের বাসা থেকে জেদাকে তুলে এনেছিলেন। পরিবারটি অন্য স্টেটে চলে যাচ্ছিলো, তাদের নতুন জায়গায় ওর থাকার জন্যে ভালো ব্যবস্থা হবে না বলে তারা ওকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়েছিলো। ওর মার্কিনি নাম ছিলো বাডি। বাডি থেকে রাতারাতি জেদা হয়ে কুকুরটির জেদ অনেক বেশী বেড়ে গেলেও মাজেদা কয়েকদিনে তা সামলে নিতে পেরেছিলেন। এবং আস্তে আস্তে ওকে সন্তানের মতো মনে করতে থাকলেন। এখন অবশ্য ওকে ডাকার সময় বলেন, “জেদা, কাম টু মামি। কুকুরটি ঠিক ছুটে আসে। “জেদা, সিট ডাউন।” কুকুরটি বসে। প্রয়োজনে কিছু বাংলাও শিখেছে সে। “জেদা, খাও।” সে খাওয়া শুরু করে। “জেদা, আমার মাথা ধরেছে” বললে ঠিকঠিক মাজেদার পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করতে থাকে। মুখ দিয়ে তার পা শোঁকে। কিন্তু কোনোক্রমেই একটি কুকুরের সঙ্গ তার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারে না। তিনি মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে আবোল তাবোল বলে চিল্লাতে থাকেন, জেদা তখন ভয় পেয়ে সোফার পিছনে লুকায়। যতোক্ষণ না মাজেদার মেজাজ ভালো হয় ততোক্ষণ চুপচাপ থাকে। অবস্থা ঠাণ্ডা মনে হলে আস্তে আস্তে এসে পায়ের কাছে এমন ভাবে বসে যে ওর মতো নিরীহ আর কেউ নেই। বোঝাতে চায়, মাজেদার রাগের কারণ সেতো নয়ই তার পূর্ব পুরুষেরও কেউ ছিলো না। জেদাকে জাপটে ধরে মাজেদা তখন হো হো করে হাসেন। বিকেলে মাজেদা জেদাকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। জেদা পথের সব অন্যায় আর আবর্জনা দূর করে দেবার পরিকল্পনা নিয়ে আগে আগে দুঃসাহসিক পা রাখে। পাড়ার অন্যান্য কুকুর দেখলে একশ’ মিটার রিলে রেসের দ্রুতগামী খেলোয়াড়ের মতো ঘেউ ঘেউ করতে করতে এমন জোরে দৌড় মারে যে মাজেদার সামলানো দুষ্কর হয়ে যায়। হাতে ধরা রশিতে প্রচণ্ড টান পড়ে। মাজেদা মুখে বলতে থাকেন, “নো নো, স্টাপ।” কিন্তু জেদার জেদাজেদির কাছে মাজেদা কখনো কখনো যে হার মানতেও বাধ্য হন না তা ঠিক নয়। একদিন হাত থেকে ছুটে তো এক মহা কাণ্ড বাধিয়ে বসে। অন্য একটি কুকুরকে এমন ধাওয়া দেয় যে তাকে একেবারে ঘরের মধ্যে তুলে দিয়ে আসে। কুকুরের মালিক মাজেদাকে শাসায়। মাজেদা বলেন, “এমন আর হবে না।” ঘরে নিয়ে জেদাকে দু’দিন খাবার না দিয়ে টেবিলের পায়ার সাথে বেঁধে রাখেন। আরেকদিন ছুটে গিয়ে এক পথচারির হাত এমন ভাবে কামড়িয়ে ধরে যে ওকে আর ছাড়ানো যায় না। শেষ পর্যন্ত যখন ছাড়ে, হাতের একগোছা মাংস উঠে সেখান থেকে তরতর করে রক্ত বেরোতে থাকে। এ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, স্থানীয় এনিমেল শেল্টারের লোক আসে। জেদাকে প্রথমে পশু হাসপাতালে তারপর সেখান থেকে শেল্টারে নিয়ে যায়। মাজেদার নামে কেস হয়। অর্থদণ্ড দিয়ে এবারের মতো মাফ পেলেও, জেদাকে আর ফিরে পান না। কিন্তু তিনি ওকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। পাগল হয়ে যান। একজন ল’ইয়ারের মাধ্যমে চেষ্টা চালাতে থাকেন। ওদিকে মাজেদার অর্থনৈতিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিলো না, সুদর্শনের থেকে যা পেয়েছিলেন, যেমন এখন যে অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকেন, সেটা, আর নগদ কিছু টাকা, যা দিয়েই চলছিলো তার সংসার। হাসপাতাল, পুলিশ, শেল্টার ও পরে রিহ্যাব ইত্যাদি করে করে মূলত জেদার জন্যে তার সর্বশেষ পুঁজিও ফুরিয়ে যায়। নিজের প্রিয় ব্রান্ডি কেনার মতো অর্থও অবশিষ্ট থাকে না। ফলত কায়ক্লেশে কখনো খেয়ে কখনো অর্ধ খেয়ে জীবন চালাতে লাগলেন। মাঝে দু’একটা জায়গায় কাজের চেষ্টাও করেন, কিন্তু তার কাঠখোট্টা কথাবার্তা শুনে কে তাকে কাজ দেবে! অনেক চেষ্টায় নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিনিময়ে স্থানীয় কলেজে একটা ক্লাস পড়ানোর সুযোগ অবশ্য তিনি কিছু দিনের জন্যে পান। খণ্ডকালীন এই চাকরি পেয়েই তিনি আনন্দে তাতাথৈ নাচতে থাকেন। উপযাচক হয়ে দু’একজন পুরোনো বন্ধুকে ফোন করে জানাতেও ছাড়লেন না যে তিনি এখন কলেজের প্রফেসর, তিনি এখন নিউইয়র্কের একটি নামি কলেজের অধ্যাপক মাজেদা খানম! একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে মাজেদা পিটার নামে এক লোককে ঘরে নিয়ে আসেন। পিটার রাস্তার পাশে বসে রোদ পোহাচ্ছিলো। পাশে একটি কার্টে ওর নিজস্ব কিছু জিনিসপত্র। দেখলেই বোঝা যায় যে তার বাড়ি ঘর নেই। রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটিয়ে দেয়। নোংরা কাপড় থেকে গন্ধ বেরোয়। মাজেদা পিটারের কাছে গিয়ে বলেন, “হাই!” পিটার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দ্বিতীয়বার হাই বললে পিটার রাগে গদগদ করে ওঠে। বলে, “হোয়াট দ্যা ফাক ইউ ওয়ান্ট!” মাজেদা বলেন, “মি! মাজেদা! আই ওয়ান্ট ইউ!” পিটারের মতোই ভাষা ব্যবহার করেন। “হোয়াট দ্যা ফাক ইউ টকিং এবাউট, ইউ বিচ!” পিটার গর্জে ওঠে, “গেট দা ফাক আউট অব হিয়ার।” “ডোন্ট ক্রাই, ইউ বাম! আমি তোর বন্ধু হতে চাই।” “মি নো হ্যাভ এনি ফ্রেন্ড, ইউ গেট লস্ট!” পিটার বলে। “তোর কি নাম?” মাজেদা জিজ্ঞেস করেন। “গেট লস্ট ইউ বিচ, আই ওয়ান্ট টু ফাক ইউ।” “সিওর, লেটস গো,” মাজেদা পিটারের সাথে সুর মেলান। এইভাবে কিছুক্ষণ তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর একসময়ে পিটার একটু শান্ত হয়। মাজেদার কথা শোনে, নিজের পরিচয় দেয়; বলে, “আমি পিটার।” রাস্তায় রাস্তায় তার জীবন সে তা স্বীকার করে। কেউ তার সাথে ভালো করে কথা বলে না বলেই সেও কারো সাথে ভালো বাক্য বিনিময় করা ভুলে গেছে এ কথা অকপটে জানায়। মাজেদা পিটারকে ঘরে নিয়ে আসেন। মনে হতে থাকে যে তিনি জেদাকেই নিয়ে আসছেন। কলেজের চাকরির পয়সায় থেকে নতুন কেনা ব্রান্ডি খাওয়ান। তার অভূক্ত শরীর জেগে ওঠে। মনের আনন্দে মন্থন করেন অচেনা দেহ। কিন্তু তার কাছে কিছুই অচেনা মনে হয় না। কতো দিনের চেনা যেনো এই পিটার। একসময় পিটার উঠে দাঁড়ায়। বলে, “আই অ্যাম হাংরি।” “হু দা ফাক গনে গিভ ইউ ফুড নাও।” মাজেদা খেঁকিয়ে ওঠেন। “আই গেভ ইউ মাই বডি, বিচ। নাও গিভ মি সাম ফুড। আই হ্যাভ নো মানি টু বাই ফুড।” পিটার যুক্তি দেখায়। “নাও গেট আউট, ইউ মাদার ফাকার!” মাজেদা বলেন। পিটার ফ্রিজ খুলতে যায়। মাজেদা চেঁচিয়ে ওঠেন, “ডোন্ট টাচ মাই ফ্রিজ উইথ ইয়োর ফিলথি হ্যান্ডস।” “আই টাচড ইয়োর বডি উইথ দেম!” পিটার হাসে। মাজেদা শরীরের এলোমেলো কাপড় ঠিক করে পিটারকে দু’খণ্ড পাওরুটি ও গ্লাসে করে জুস দেন। “ডোন্ট ইউ হ্যাভ ব্রান্ডি?” পিটার জিজ্ঞেস করে। “গেট দা ফাক আউট অফ হিয়ার। যা দিয়েছি তাই খা। আর খেয়ে বিদেয় হ।” মাজেদা আবার চটেন। “ওকে ওকে। ডোন্ট বি ন্যাস্টি। আই অ্যাম লিভিং।” রুটি আর জুসের গ্লাস হাতে নিয়েই দরজার দিকে পা বাড়ায় পিটার। “আমার গ্লাস রেখে যা,” ধমকের সুরে বলেন মাজেদা। বাঁ হাতে রুটি ধরে, ডান হাতে এক চুমুকে জুস শেষ করে গ্লাস টেবিলে রেখে বেরিয়ে যায় পিটার। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর সামনে রাখা তার কার্ট নিয়ে রুটি কামড়াতে কামড়াতে অদৃশ্য হয়ে যায়। মাজেদা দোতলার জানলা দিয়ে তার যাবার পথে তাকিয়ে থাকেন। কয়েকদিন কেটে যায়। পিটারকে কোথাও দেখা যায় না। কলেজে যাওয়া আসার পথে এদিক সেদিক তাকিয়ে আতিপাতি খোঁজেন তাকে। সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই তার পঞ্চাশোর্ধ্ব শরীর আবার পিপাসার্ত হয়ে ওঠে। শরীরকেও দোষ দেয়া যায় না, ও যতো চায় ততোই পাওয়ার আগ্রহ দানা বাধে কোষে কোষে। দু’সপ্তাহের মাথায় মাজেদা একদিন বাসায় ফিরে সন্ধ্যার কিছুটা আগে আবার বেরিয়ে যান। বাসার পাশের পার্কে হাঁটতে হাঁটতে নানান রকম মানুষের দিকে চোখ রাখেন। বিকেলের খেলাধূলা শেষে ছেলেপুলেরা সবে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। এলোমেলো বাতাস চুলে বিলি কেটে পালিয়ে যাচ্ছে। মাজেদা দেখেন পার্কের এক কোণে ওয়াটার ফাউন্ট-এর পাশে পড়ে পড়ে ঝিমোচ্ছে একটা লোক। তার মনে হয় এই বুঝি পিটার। আবার ভাবেন পিটার হলে তো তার কার্টটাও থাকতো। তাহলে কি অন্য কেউ? তিনি পায়ে পায়ে গিয়ে লোকটির পাশে বসেন। অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো খেঁকিয়ে ওঠে লোকটা, “হোয়াট দ্যা ফাক ইউ ডুইং?” মাজেদা বুঝে যান যে সে পিটার নয়। নম্র ভাষায় বলেন, “আমি দুঃখিত, ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আমার বন্ধু পিটার।” “তোমার বন্ধু! পিটার! হা হা হা! ইয়োর ফ্রেন্ড! আর ইউ আউট অব ইয়োর মাইন্ড?” শেষের বাক্যটা কিছুটা নমনীয় মনে হয়। “পিটারকে তুমি চেনো?” জিজ্ঞেস করেন মাজেদা। “না, আমি পিটার নামে কাউকে চিনি না। তবে গত কয়েকদিন ধরে সিটি ভীষণ ধড়পাকড় করছে। হোমলেসদের শেল্টারে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কোনোরকম পালিয়ে বেঁচেছি। শেল্টারে যেতে চাই না।” “কেনো?” “বন্দী জীবন ভালো লাগে না।” “খাবার পাবে, থাকার জায়গা পাবে, তারপরেও ভালো লাগে না!” “না, ভালো লাগে না।” “সে কি কথা?” “স্বাধীনতা নেই। আমি স্বাধীনতা চাই। আমার মতো করে ঘুরতে চাই। যখন যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যেতে চাই। যখন যেখানে জায়গা পাই ঘুমিয়ে পড়তে চাই। ঘুমের থেকে জাগতে না চাইলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাই। তুমি ওসব বুঝবে না।” “আমার সাথে যাবে?” “কোথায়?” মাজেদার কথা শুনে আঁৎকে ওঠে লোকটা। “তোমার সাথে! কি বলো?” “হ্যাঁ, আমার সাথে, আমার বাসায়, এখান থেকে দুই ব্লক পরেই রাস্তার কোণায় বড়ো একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকি আমি। আমার নিজের বাসা।” “তোমার মাথা ঠিক আছে তো?” “দিব্যি আছে। ও নিয়ে ভেবো না তুমি।” মাজেদা তারপর লোকটাকে রাজি করিয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। লোকটা জানায় ওর নাম গ্লেন। মাজেদা অবশ্য বলেন যে যতোক্ষণ লোকটা তার সাথে থাকবে ততোক্ষণ সে গ্লেন নয়, পিটার। গ্লেন রাজি হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা বলেই সারারাত মাজেদা গ্লেনকে রেখে দেন। শনি-রবি যেহেতু ছুটি তাই সময়টা আনন্দে উদযাপন করেন। সকালে গ্লেন বিদায় নেয়। এইভাবে প্রতি সপ্তাহান্তে মাজেদা রাস্তা থেকে, পার্কের গাছতলা থেকে, সাবওয়ের অন্ধকার থেকে একজন একজন করে পিটার, গ্লেন, রজার, হোয়ানকে ধরে আনেন। শরীরকে কিছুক্ষণের জন্যে ওদের হাতে ছেড়ে দেন। পুরো সপ্তাহ সেই সুখস্মৃতি বয়ে বেড়ান। ওদের গায়ের গন্ধ তার অনেকটাই ভালো লেগে যায়। তিনি ভাবেন চোখ বন্ধ করলে সব শরীরই একরকম। তাছাড়া তার এই বয়সে তাকে, এই হাড় জিরজিরে শরীরের মাজেদাকে কেউ ভালবেসে কাছে ডেকে নেবে না তা তিনি ভালো করেই জানেন। ফলে, নিউইয়র্ক শহরের বৃদ্ধ হোমলেসরাই তার জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকে। অন্তত ক্ষণিকের জন্যে হলেও। সময় বেশ ভালোই কাটে। এর মাঝে ল’ইয়ারের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত জেদাকেও ফিরে পান তিনি। ওকে পেয়ে সকালের এক ঝলক রোদ্দুর পাওয়ার মতো আনন্দে মেতে ওঠেন। জীবন যেনো আবার আগের মতো হয়ে যায়, চাইকি তার থেকেও সচল, শক্তিশালী, দাম্ভিক। অবশ্য রিহ্যাবের ডাক্তার সতর্ক করে দেন, জেদার যে অসুখ তা যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে। ফলত, ওর সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা, ভ্যাকিউম চালানো, চিৎকার করা বা টিভিতে মারপিটের কোনো ছবি ওকে পাশে বসিয়ে দেখা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে বলেন। মাজেদা বিষয়টি মেনে চলেন এবং সম্ভব হলে ওকে না নিয়েই বাইরে হাঁটতে বেরোন, বা টুকটাক বাজারের কাজে যাওয়া ইত্যাদিতে আর জেদার সঙ্গ তিনি কামনা করেন না। জেদা বরং ঘরে সুখে কাটায়। ওকে একা রেখে যাবার সময় টিভিতে ডিজনির কোনো কোমল ছবি ছেড়ে রেখে যান, কিম্বা বাচ্চারা যেসব ছবি দেখে যেমন বব দ্যা বিল্ডার, ডরা, স্পঞ্জ বব ইত্যাদি। অন্যদিকে বাইরে থেকে কাউকে নিয়ে এলে জেদাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা টেনে দেয়া হয়, যাতে মাজেদার কাজে কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ কুঁইকুঁই করে শান্ত হলেও কখনো কখনো শীৎকারে বিচলিত হয়ে আবারো ঘেউ ঘেউ শুরু করে, এবং এক সময় মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। মাজেদার জীবন এক প্রকার চলেই যাচ্ছিলো। নিঃসঙ্গতা কাটাতে মাঝে মধ্যে দু’একজন বন্ধুর বাড়িতে হানা দেয়াও হচ্ছিলো, যদিও তিনি অনেকাংশেই ছিলেন অনাকাক্সিক্ষত। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিতে বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন তিনি; খণ্ডকালীন চাকরিতে ছুটির সময় কোনো বেতন দেয়া হয় না। ফলে এই সময়টা অর্থনৈতিক সঙ্কটে কাটে। নানা দিক দিয়ে সেই সঙ্কট এতোটাই প্রকট হয়ে দেখা দেয় যে মাজেদা উত্তরণের কোনো পথ পান না। কখনো এক পেটা কখনো আধ পেটা খেয়ে, কোনো দিন জেদাকে খাইয়ে কোনো কোনো দিন উপোস রেখে কোনোভাবে চলছিলো। এ সময়ে হঠাৎ হয়তো কখনো পুরোনো বন্ধুর বাসায় হাজির হতেন। এক বেলা খেয়ে অন্য বেলারটাও যাতে যোগাড় করে আনা যায় সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতেন। কারো বাসা থেকে দু’টি মরিচ একটা পিঁয়াজ দু’টুকরো আলু ধার নিতেও পিছপা হতেন না। ওদিকে চাকরিরও চেষ্টা করতে থাকলেন। খিটখিটে মেজাজ আর শুষ্ক কথাবার্তা শুনে দরজা থেকেই ছোটোখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কাপড়ের দোকান, গ্রোসারী শপ থেকে বিদায় করে দেয়া হয়। নিজের খাবার কোনো ভাবে যোগাড় হলেও জেদা নিয়মিত না-খেয়ে থাকতে থাকতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবার অবস্থায় উপনীত হয়। মাজেদা উপায়ান্তর না দেখে একদিন সন্ধ্যার পর জেদাকে বরাবরের মতো ঘরে আটকিয়ে ট্রেন ধরে সোজা গিয়ে নামেন ফোর্টিন স্টীটে। নয় নম্বর এভিনিউ-এর কোণায় রাত এগারোটার দিকে দাঁড়িয়ে দেখেন ঢের স্বাস্থ্যবান রূপসীরা সেজেগুঁজে কাক্সিক্ষত কাস্টোমারের আশায় হেসেখেলে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। এবং একে একে গাড়ি এসে দেখে শুনে ওদের নিয়েও যাচ্ছে, কিন্তু হায়, কেউ মাজেদার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সময় যেনো তার কাছে বড়ো নির্মম হয়ে উঠছে। নিজেকে তিনি কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছেন সেটা বোঝার বোধ ও বুদ্ধি তার নেই তা ঠিক নয়, কিন্তু জীবন যে বড়ো আত্মঘাতী; তার পরতে পরতে জড়ানো বিষ, ভয়াবহ বিষাক্ত পিপাসা! এক, দুই, তিন রাত এভাবে বিফল হয়ে সূর্যোদয়ের আগে বাসায় ফিরে অসাড়ের মতো সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমালেন, আর ঘুম ভাঙতেই হতভাগা জেদাকে দেখে তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো। না, চতুর্থ রাতে মাজেদাকে আর বিফল হতে হয়নি। একজোড়া চুল পাকা বুড়ো তাকে তুলে নিয়ে গেলেন নিউজার্সির উপকূলে হ্যাকেনস্যাক শহরে। তারপর সকালের আলো ফোটার আগে তার বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার সময় একশ’ ডলারের একটি চকচকে নোট ধরিয়ে দিলেন। বাসায় ঢোকার আগেই জেদা ও নিজের জন্যে গ্রোসারী থেকে খাবার কিনে আনলেন, আর সেই খাবারে মুখ দিয়ে জেদা কুঁইকুঁই করে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যে কী আবেগ প্রকাশ করলো তা একমাত্র অভূক্তরাই জানে। এইভাবে দু’চারদিন পর পর কোনো কোনো রাতে মাজেদার আয় কিছু না কিছু হচ্ছিলো, যা দিয়ে তার চলেও যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ এক বিপত্তি তার সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। এক রাতে তাকে তুলে নিয়ে যান এক ভদ্রলোক, যিনি জানান যে এই শহরে তিনি নতুন, বেড়াতে এসেছেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার বন্ধু। ভদ্রলোক জানান, বন্ধুর বাড়ি কুইন্সের জ্যামাইকা এলাকায়। সেখানেই থাকছেন তিনি। গাড়িতে বসে প্রথমে ইংরেজীতে কথাবার্তা বললেও মাজেদা ভদ্রলোকের উচ্চারণ ভঙ্গিতে ধারণা করলেন যে তিনি হয়তোবা ভারতের কেরালা অঞ্চলের বাসিন্দা হবেন। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে লোকটা জানালেন, “নো নো, আই এম ফ্রম বেঙ্গল।” তখনই মাজেদার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, “ও তাই বলেন।” অতএব নিজেকে আর লুকানো গেলো না। শুরু হলো বাংলায় আলাপ বিনিময়। নানা রকম গল্প করতে করতে জ্যামাইকায় পৌঁছে গেলেন তারা। একটি ছিমছাম দোতলা বাড়ির নিচতলার বসার ঘরে ওদের কথাবার্তা হতে লাগলো। টিভিতে চলছিলো হিন্দি ছবি। মাজেদা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে ভদ্রলোকের নাম রজত ঘোষ, যিনি পশ্চিমবঙ্গের একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেন। “তুমি বাংলার বাইরে কতো বছর,” রজত জিজ্ঞেস করলেন? “বছর পঁচিশেক,” মাজেদা উত্তর দিলেন। “এই পেশায় কতো দিন?” মাজেদা বললেন, “দেখুন এটা আমার পেশা নয়। আপাতত করছি আর কি! আমি একজন প্রফেসর!” “প্রফেসর!” রজত ঘোষ অবাক হয়ে বললেন, “তা তুমি কি পড়াও?” মাজেদা বললেন, “আমি ইংরেজী সাহিত্য পড়াই,” এবং সাথে সাথে আপত্তি জানিয়ে বললেন, “আমাকে কেনো তুমি করে বলছেন!” ইতিমধ্যে গ্লাসে কয়েক চুমুক দিয়ে রজত ঘোষের মাথায় রক্ত উঠে গেছে, তিনি বললেন, “চুতমারানি, তোর কাপড় খোল, কিসের বালের প্রফেসর তুই, আমি আগে দেখি।” মাজেদা রাগে গমগম করতে থাকলেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই, রজত ও তার বন্ধু তাকে উলঙ্গ করে ফেললো। রজত বললেন, “তো প্রফেসর বিবি, তোমার শরীরের যে ভাঙাচোরা অবস্থা, এখানে তো কিছু নেই, আমাদের কি দিয়ে আপ্যায়ন করবে!” ওর বন্ধু অবশ্য বললেন, “শালা, রাখ তোর শরীর, যা আছে তাই ধর! এতেই চলবে।” রজত বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললেন, “তুই শালা ঘরে যা। আজ ওর সাথে আমিই থাকি।” “তা হবে না।” খেঁকিয়ে উঠলো বন্ধু। “না না দেখ আমরা দু’জন এক সাথে ধরলে এই মাগি মারা যাবে, মাগি নাকি প্রফেসর, ওকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব, আমার উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করবে। হ্যাঁ, মাগি আলোচনা করবে আমার উপন্যাস নিয়ে, হা হা হা!” কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই বন্ধুই পালাক্রমে উপবিষ্ট হন। মাজেদার খটখটে শরীর সব সহ্য করার ক্ষমতা ইতিমধ্যেই অর্জন করে নিয়েছে। অতএব, এই অমাবস্যায় যতোটা সম্ভব নিজের মতো থাকার ব্যাপারটা আয়ত্ত করে নিতে হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। ঔপন্যাসিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, “তা তুমি কার কার উপন্যাস পড়ো?” মাজেদা বলেন, “গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, হোসে সারামাগো, টনি মরিসন...” ঔপন্যাসিক তাকে থামিয়ে দিয়ে টেনে টেনে বলেন, “রাখো রাখো এতো গেলো বিদেশী, বাংলা ভাষার কার কার উপন্যাস পড়ো?” একদিকে যেমন তিনি শরীর ক্রিয়ায় ক্লান্ত, অন্যদিকে সিভাস রিগালের ঝাঁজে আলুথালু। “আজকাল কেউ লিখতে পারে না। বাংলা উপন্যাস পড়ি না!” “কয় কি, কেউ লিখতে পারে না! এই দেখো আমার দিকে তাকাও, আমি রজত ঘোষ, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, বইমেলাতেই আমার একেকটি উপন্যাসের দশ বারোটি করে এডিশন হয়। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার লেখা বই কিনতে। রজতের কণ্ঠ অনেকটা জড়িয়ে যায়।” মাজেদা বলেন, “ক্লাস ফাইভের একজন ছাত্র যতোটা বাংলা জানে তুমি ততোটুকুও জানো না। তোমাদের ঔপন্যাসিকদের ফাইভে ভর্তি হয়ে আগে বাংলা শেখা দরকার। তোমরা যা লেখো বাচ্চারাও পড়তে পারে না। ওগুলো বস্তাপচা, গোবর।” “মাগি বলে কি, বেশ্যা মাগি বলে কি!” চিল্লিয়ে ওঠেন রজত ঘোষ, “মাগিকে বের করে দে। মাগিকে বের করে দে!” “তোমরা বাল লেখো! ওসব পড়া যায় না। কেউ পড়তে পারে না।” মাজেদাও কম যান না। এরই মধ্যে দশ ডলারের তিনখানা নোট তার মুখের উপর আছড়ে পড়ে। রজত তার মানিব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে মাজেদার মুখে ছুঁড়ে মারেন, “এই নিয়ে বের হয়ে যা। এখনই বের হ! বেশ্যা আবার প্রফেসর! বের হ, মাগি বের হ!” মাজেদা গম গম করতে থাকেন। ভিক্ষে দেবার মতো সামান্য টাকা ও অপমান দুটোই তাকে সমান বিদ্রোহী করে তোলে। কিন্তু কিছু একটা বলবেন বলে মুখ খোলার আগেই রজতের বন্ধু দরজা খুলে তাকে ঠেলে বাইরে ফেলে তৎক্ষণাৎ সশব্দে বন্ধ করে দেয়। রাত তিনটেয় এইভাবে নিষ্ক্রান্ত হয়ে মাজেদা অনেক কষ্টে বাসায় ফেরেন। ট্রেন ধরে বাসায় পৌঁছাতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায়। ঘরে ঢুকেই জেদাকে জড়িয়ে ধরেন। অনেকক্ষণ কাঁদেন, তারপর জেদাকে খেতে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গরম পানি ছেড়ে গোসল করেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন সকালের আলো ফুটে উঠেছে। চিনা মাটির একটি বিশাল মগে চা ও দুই টুকরো পাউরুটি নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে নাস্তা খেতে খেতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েন। প্রায় এগারোটা নাগাদ ঘুম ভাঙে। রাতের ঘটনাকে তার কাছে অনেকটা দুর্ঘটনাই মনে হয়। রজত ঘোষের সাথে তার হয়তো জীবনে আর কখনোই দেখা হবে না। কিন্তু তার মুখখানা মনে পড়তেই প্রেসারটা বেড়ে যায়, ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়। তিনি পায়ে পেষা পাতার মতো সেই মুখ ভুলে যেতে চান। কিন্তু কেনো যেনো বার বার সামনে এসে খাড়া হয়। মাজেদা বিড়বিড় করেন, “তুই তো দুই পয়সার ঔপন্যাসিক। দুই পয়সার লেখক। তোর মতো কতো লেখক ড্রেনের নোংরায় গড়িয়ে গেলো। গড়িয়ে যাবে!” অনেক দিন পর জেদাকে নিয়ে তিনি হাঁটতে বেরোন। রাস্তা পেরিয়ে সাবওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে ‘এই দিকে সিটি কলেজ’ লেখা সাইন ডানে ফেলে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়-মতো পার্কের উপরের দিকে উঠে গাছের ছায়ায় দুর্বা ঘাসে বসে নিচের দিকে চোখ রাখেন। ডানে সমতলের মতো একটি জায়গায় অনেকগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে বাস্কেট বল খেলছে। অন্যদিকে পাহাড়ের উপর থেকে ইউনিফর্ম পরা আরেকটি দল জগিং করতে করতে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পার্কের আবর্জনা পরিষ্কার করছে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মচারী। বাইরে বেরিয়ে জেদা খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে যায়। এদিক সেদিকে ছুটে পৃথিবীকে জানান দেয় যে এখনও মাজেদার বুলডগ নিজের শক্তি সম্পূর্ণ ধারণ করে বেঁচে আছে, ওর গলায় বাঁধা দড়ি যদিও মাজেদার হাতে। দুর্ঘটনার কথা মনে রেখে তিনি জেদাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি নন। মাজেদা বলেন, “ডোন্ট গো ফার্দার ফ্রম মামি। জেদা, জেদা, মামি ইজ হিয়ার। এখানে থাকো।” শান্ত বালকের মতো জেদা আবার মাজেদার পায়ের কাছে এসে বসে। দুপুর পড়ে গেলে ওরা ঘরে ফিরে আসে। মাজেদার বেশ ক্ষুধা অনুভূত হয়। জেদাও কুঁইকুঁই করে জানান দেয় যে তারও ক্ষুধা লেগেছে। জেদাকে খাবার দিয়ে মাজেদা নিজের জন্যে স্যান্ডুইচ বানান। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। কলার আইডি দেখে তিনি ফোন না ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত রিসিভার তোলেন। “তুমি কোন ফোন কম্পানি ব্যবহার করো? আমাদের কম্পানি অনেক কম পয়সায় লাইন দিতে পারে।” ওপাশ থেকে ভেসে আসে। মাজেদা কিছু বলার আগেই, সুললিত কণ্ঠে আবার শোনা যায়, “তুমি ইন্টারন্যাশনাল কল করো কোন দেশে? আমরা ১০০ মিনিট পর্যন্ত ফ্রি দিতে পারি।” মাজেদা বলেন, “আমার এখন ইন্টারন্যাশনাল লাইনের দরকার নেই। তাছাড়া আমার ফোন ঠিক আছে। আমি এখন কম্পানি চেঞ্জ করতে চাচ্ছি না।” “না, না, তুমি বুঝতে পারছো না, এতে তোমার অনেক সেভ হবে,” সুললিত কণ্ঠ লোভ দেখায়। রেগে-মেগে মাজেদা দড়াম করে ফোন রাখেন। তার মুখ দিয়ে শুয়োরের বাচ্চা, হারামির বাচ্চা, মাদার ফাকার, গো টু হেল ইত্যাদি বেরোতে থাকে। রাগের চোটে ইজি চেয়ারে বসে পড়েন। চিল্লাতে থাকেন। ওদিকে জেদা খাওয়া রেখে গম গম করে ওঠে। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই মাজেদার গায়ে লাফিয়ে পড়ে বাঁ হাতের উপর দিকে জোরে কামড়িয়ে মাংস তুলে নেবার উপক্রম করে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাজেদা হতচকিয়ে যান। কি করা উচিত বোঝার আগেই তার হাত বেয়ে গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “হোয়াট আর ইউ ডুইং জেদা, মামি ইজ গেটিং হার্ট। মামি ইজ গেটিং হার্ট, লিভ মি এলোন, ডোন্ট ডু দ্যাট।” কিন্তু জেদা আরো উত্তেজিত হয়ে বাম হাত ছেড়ে ডান হাতে কামড় বসায়। মাজেদা এবার চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যান। বাঁচার চেষ্টা করেন। ছুটে যাবার চেষ্টা চালান। কিন্তু জেদার শক্তির সাথে পেরে ওঠেন না। হঠাৎ হাতের কাছে চায়ের মগ পেয়ে যান এবং বাঁচার তুমুল প্রচেষ্টায় মগের ডাণ্ডা ধরে জেদার মাথায় সজোরে আঘাত করেন। এতে কাজ হয়। জেদা ছিটকে পড়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে। মাজেদা দেখেন ওর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। চোখের সামনে তার প্রাণের কুকুর দাপাতে দাপাতে নিমেষে শেষ হয়ে যায়। ওদিকে মাজেদার দুই হাতের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরেই চলে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মাজেদা জেদার মৃত শরীর আঁকড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। জেদা এবং মাজেদার রক্তের ধারা এক হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে যায়। কুকুর আর মানুষের রক্ত তখন আর আলাদা করার কোনো উপায় থাকে না। |