সময়কে এইভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো
|
সাহিত্য/কবিতা মনসুর আজিজ
দু'টি কবিতা পালাগান তোমার সান্নিধ্য পেতে অসীম আকাশে রাখি কান কিছুই শুনি না আমি অনুভবে শুনে যাই সব ওপারের আকাশকে ইশারায় করি আহবান ভুলো মনে শুনে যাই পাখিদের কলকলরব নিজের ভিতর খুঁজে পাই শুধু নিজ অনুভব। মুগ্ধ শ্রোতা কখনো বা কোরাস কাঁপনে সারারাত পার করে মুগ্ধতার বীজ বোনে ভোরের সিথানে পানপাত্রে গণিকার দেহভাজে মাছিদের হাত ওলানের দুগ্ধ চোষে পড়শির বাছুর বাথানে রাখালের দুই চোখ অশ্রুতে ভয়াল রাত আনে। রূপবান ক্ষত হয় পালাগানে মধুমালা লাশ রহিমের জং ধরা তরবারী; ছিন্নভিন্ন পাল দড়ি হয় দরিয়ার মাঝখানে মদনের ফাঁস নোনা জলে মিশে আত্মা চোখ হয় ফুলকার লাল সমুদ্রের গানে বাজে আত্মারই সুর লয় তাল। অনুভবে আজো পাই পালাগানে মহুয়ার গান গভীর রাত্রিতে জেগে শুনি সমুদ্র গর্জন আমি অসীম আকাশে থাকে ইশারার সুর অভিমান। গেরুয়া গায়ক পাখি গেরুয়া গায়ক পাখি গেয়ে যায় অন্তর বাগানে জারিসারি সঙ্গীতের বাণী বাউরি বাতাসে দোলে দেহতত্ব বৃক্ষ ভেদে শিকড়ের সুর তুলে আনে পরতে পরতে মাটি দেহের জীবাষ্ম টেনে খোলে আদি সুর মূর্ছনার স্বরলিপি এই মন ভোলে। মাটিও মানুষ ছিল স্বরগ্রাম সঙ্গীতের পুরী আদিসুর বেজে বেজে ক্ষয় হয় তানপুরা তার আদমের কিস্তি বায় পুবে নুহের উত্তরসূরী তাতারের স্পর্শ পেয়ে কেঁদে মরে করুণ সেতার খুরধ্বনি তরবারি ধ্বনি তোলে যুদ্ধ জেতার। রক্তের সুস্বাদ পেয়ে দ্রাঘিমা রেখারা শুধু হাসে সবুজ পাতার দাগে জেনে নেই বংশ লতিকা গাছের বাকল খুলে পূর্বসুরী আরো কাছে আসে স্নেহের পরশ কাঁধে রেখে চলে দূরে যায় পিতা গাছের শিকড় ভেদে সারগাম বাজে সঞ্চিতা। জীবনের সঙ্গীতও সুর লয়ে বিভোর আপন রক্তের সিম্ফনি এঁকে যায় বহুদূর তটরেখা গেরুয়া গায়ক পাখি রেখে যায় তন্ত্রীতে কাঁপন। নিবন্ধ মাহমুদুল হক সৈয়দ
কবিতা : অনুধাবন ও সংশোধন “ And yet for a hundred indecisions And for a hundred visions and revisions” এ-কথা নিরংকুশভাবে বলা যায় না যে, কোনও কবির তাৎক্ষণিক ভাবনা থেকে নির্গত প্রাথমিক খসড়ায় বর্ণিত কথাগুলি দিয়েই একটি কবিতার সুস্পষ্টভাব প্রস্ফুটিত হয়। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু ব্যতিক্রমটা সৃষ্টি হয় দীর্ঘকালের কাব্যানুশীলন থেকে; কখনো সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে। তবে এ-কথা সত্য যে, প্রাথমিক খসড়া ও তার অসম্পূর্ণতার ভেতর থেকেই কবিতার একটা সহজাত ও স্বাভাবিক বৈশিষ্টমূলক গুণাগুণ যথা—স্বাভাবিকতা, স্বতস্ফুর্ততা ও অপ্রত্যাশিত সুরেলাধ্বনি বেরিয়ে আসে। কখনো মনে হয় একটা অজানা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি নির্মাণ করে চলেছেন কবিতার শরীর। মনের এনটিনা দিয়ে কল্পলোক হতে যা কিছু গ্রহণ করছেন তা যেনো পর্দায় সম্পূর্ণ ভেসে উঠছেনা। প্রিয়-শব্দ-ফুল দিয়ে যেনো কবিতার হৃদ্য মালাটি গাঁথা যাচ্ছেনা। এটা কবির একটা অদ্ভুত অনুভূতি তার নিজ সৃষ্টিরপ্রতি। এ অনুভবটা জনে জনে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু অনেক কবিরই এ-ভাবনা জন্মায় ঘটনাক্রমে, যেনো সচেতনভাবে কবিতার আদ্যন্ত সাজানো যাচ্ছেনা। যাই হোক, প্রথম খসড়ায় বর্ণিত কবিতার কথাগুলি যখন একটা বিমুগ্ধ-ভাববিহ্বলতা বা বৈসাদৃশ্য ভাবের সৃষ্টি করে, তখনই প্রয়োজন দেখা দ্যায় কবিতা রিরাইটিং বা পুনর্লিখনের। এ-ছাড়া কবিতার লাবণ্য, কবিতার সংগীতকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে কবিতা অনুধাবন ও সংশোধন তো অপরিহার্য। এ-কথা মনে রেখেই কবিকে অনুপুংখভাবে দেখতে হয় তার কবিতার ঠিক জায়গাগুলিতে সঠিক শব্দের প্রয়োগ হয়েছে কিনা? এটা অতিস্বাভাবিক কবি তার প্রাথমিক বর্ণনায়; আবেগের অতিউষ্ণতায় কিংবা অনুভূতির প্রাবল্য চঞ্চলতায় কখনো ঠিক শব্দের কাছাকাছি শব্দ দিয়ে দ্রুত রূপদানের প্রয়োজনে নির্মাণ করে যান কবিতার কাঠামো। কবিতার প্রমূর্তভাবটি ফুটিয়ে তুলতে ওইরূপ তড়িৎ সিদ্ধান্তের কথা মনে রেখে পুনর্লিখনের সময় সর্বাধিক উপযোগী শব্দ প্রয়োগ করার বিষয়টিও যথারীতি বিবেচনায় আসে। দ্বিতীয় যে বিষয়টির প্রতি মনযোগ দেয়া যায় তা হলো, কবিতায় অতিরিক্ত কিছু বর্ণিত হয়েছে কিনা? বর্ণনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কিনা? কবিতার এক অংশের চেয়ে অন্য অংশ দুর্বল কিনা? এসব ক্ষেত্রে কবিতার টোন পরিবর্তন না-করে সংশোধনের ক্রিয়াটি সম্পাদন করার দরকার পড়ে। বলা বাহুল্য, সামান্য পরিবর্তনে এবং সংশোধনে কবিতা হয় আরো শক্তিশালী। তবে সংশোধনের সময় কবিকে যত্নশীল হতে হয় প্রাথমিক বর্ণনায় লিখিত কবিতার ভাব ও বিষয়বস্তুর প্রতি। সহজাত ও স্বাভাবিক বৈশিষ্টগুলি যেনো কবিতা থেকে বাদ না পড়ে। কিংবা অতিরিক্ত যতিচিহ্ন ব্যবহৃত না হয়। সঠিক জায়গায় এসে কবিতা সংশোধনের কাজটি শেষ করার চেয়ে কঠিনতর বোধ হয় আর কিছু নেই। আর এ-জন্যে কবিকে এ-ও মনে রাখতে হয় যে, অতিসংশোধন স্বাভাবিকভাবে কবিতার সংকট সৃষ্টি করে–কবিতার অঙ্গহানি করে। উত্তমপন্থা হলো, কবিতা লেখার পর পান্ডুলিপিটি কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্যে চোখের আড়াল করে রাখা। পরে সুন্দর কোনো এক সময়ে অনুধাবন ও সংশোধনের কাজে হাত দেয়া—যা আবেগের অতিউষ্ণতা থেকে কবিতাকে স্বাভাবিকভাবে রক্ষা করে; স্বচ্ছ ও সুন্দর কবিতা উপহারে প্রমিত সাহায্য করে। গল্প মোজাফফর হোসেন
চিঠি চৈত্রের কোন এক ফুটন্ত দুপুরে মায়ার বিয়ে হয়ে গেলো। খুব বেশি লোকসমাগম ঘটেনি তবুও বেশ কোলাহলের মাঝেই বিবাহের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন হল; পাত্র পক্ষের দাবী কড়ায়-গণ্ডায় পূরণ করা হয়নি বলেই পর্যাপ্ত কোলাহলের সৃষ্টি; এবং যথাসময়ে সব শেষও হল; একেবারে নিশ্চুপ-নিস্তেজ হয়ে পড়ল বিয়ে বাড়ি; যেনো আকস্মিক ঝড়ের পর একরাশ মৌনতা। বিয়ে হল পাশের গ্রামের চাল ব্যবসায়ী লুৎফর মিঞার বড় ছেলে মিজানের সাথে। বি.এ. থার্ড ক্লাশ; বেকারত্বের ভারে এখনো অভিশপ্ত সে, তাই বিয়ের বয়স হলেও অর্থনৈতিক অনুমোদন মেলেনি; অন্যদিকে, মায়ার বিয়ের বয়স না হলেও সময় হয়ে গিয়েছে সমাজের বিচারে । মায়া এখন শশুর বাড়িতে; নবম শ্রেণীতে পড়া একটা মেয়ে সংসারের কিই বা এমন বোঝে! স্বামী বলতে ঘোমটার আড়াল থেকে সতর্কতার সাথে দৃষ্টি নিক্ষেপ আর ঘটনাচক্রে সংঘাত ঘটলে লজ্জায় ঘটে যায় মাটি আর মায়ার মধুর একাত্বতা। বিষয়টি মিজানের বেশ ভালোই লাগে। মায়ার এই মায়াবী মোহমুগ্ধতাকে সে তীব্রভাবে উপভোগ করে, উপভোগ করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে। মেঘাচ্ছন্ন মৌনতার মুগ্ধতায় প্রতিনিয়ত মূর্ছা যায় মিজান, আত্মসমর্পণের কোন বিকল্প খুঁজে পায় না সে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছু একবিন্দুতে মিলিত হয়ে একটি মাত্র শব্দের প্রতিধ্বনি হয় তার শিরা-উপশিরাই, চেতনা-অবচেতনাই: মায়া, আমার মায়াবিনী, তোমার প্রেম তরীতে আর কত ভাসাবে আমাকে! সংসারের খুব সাধারণ সন্তান মিজান। বাবার আদেশ আর বেঁচে থাকার তাগিদকে উপেক্ষা করতে পারে না সে। কিন্তু অবুঝ বালিকা বউটি তার কিছুই বলে না; শুধু বিদেশ গমনের কথা শুনে স্যাঁতসেতে কলের পাড়ের পেয়ারা গাছটির মত স্তব্ধ হয়ে যায়। ভালোবাসার এই ভয়াবহ রূপ কল্পনা দেখে আঁৎকে ওঠে মিজান। কিন্তু বিদেশ তাকে যেতেই হবে, এই সদ্য ফোঁটা ফুলটিকে যে পৃথিবীর সব রঙ মাখায়ে দিতে। সবকিছু ঠিকমত হলে খুব শীঘ্রই সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করবে মিজান। বেশ ব্যস্ততার মধ্যদিয়েই এখন সময় কাটছে তার। এদিকে মায়া হাতড়ে বেড়াচ্ছে কূল কিনারাহীন অথই জল। বাবা-মা মারা গেছে বুদ্ধি হবার বেশ আগেই। সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় ডুব সাঁতার খেলতে খেলতে থিতিয়ে গেছে তার সকল চেতনাবোধ; মাঝে মধ্যে বেশ জোরেসোরে চিমটি কেটেও উপলব্ধি করতে পারছেনা বেঁচে থাকার আস্বাদন। এইভাবে কোনো এক শুক্রবার আসে। খুব ভোরে চলে যাবে মিজান। সারারাত মায়া তার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনা, যেনো সাত বছরের বালিকা তার পুতুল খেলার সঙ্গীর সাথে আড়ি ধরে অভিমানি প্রহর গোণে। মিজান যাবার পর, মায়া সারাদিন আকাশের নীল গম্ভুজ দেখায় ব্যস্ত, এমনকি উড়ে যাওয়া যান্ত্রিক পাখিগুলোও তার ভালোবাসার একটি বিশেষ বিষয় হয়ে উঠে, দিনে অন্তত দু'একবার না দেখলে তার ভালো লাগেনা। অন্যদিকে মেঘ হয়ে ওঠে তার পরম শত্রু; মেঘলা দিন সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর; কারণ আকাশের পাজা পাজা মেঘ নীলাকাশ দেখাতে তাকে বাধা দেয়। এমন এক মেঘলা দিনে দাদী শাশুড়ীর ডাকে চমকে ওঠে মায়া, “নে তোর নাগর চিঠি পাঠিয়েছে।” চিঠিখানা বিছানায় রেখে চলে যান তিনি। মায়া যেন আকাশ থেকে পড়ে, যেন জ্ঞান শূন্য থাকে অনেকক্ষণ; তারপর চিঠিটা বুকের ওপর চেপে ধরে এমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যেনো সে দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুব দিয়ে ছিলো। মায়া শূন্যে ভাসিয়ে দেয় তার দৃষ্টি কারণ এই মুহূর্তে সে এর থেকে মূল্যবান উপহার আর কি-ই বা দিতে পারত? চিঠিটা খুব সাবধানে খোলে যাতে কোন কাঙ্খিত অংশ ছিঁড়ে না যায়। মায়া, আমি ঠিকমত পৌঁছেছি। আগামীকাল কাজে যোগ দেবার কথা। খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি, তাই বেশি কিছু লিখছি না। তুমি নিজের ও বাবা-মার প্রতি খেয়াল রেখো আর কেমন আছো জানিয়ো। ইতি তোমারই, মিজান যত সময় লাগার কথা তার থেকে কয়েকগুন কম সময়ে চিঠিখানা পড়ে ফেলে মায়া, তারপর বহুবার। চিঠির ঐ নিস্প্রাণ অতি সাধারণ কথাগুলোকেও যেন তার কাছে কাব্যের মত শোনায়। কথাগুলো মুখস্ত করে, যে বিদ্যাতে সে আদৌ অভ্যস্ত নয়, সারাদিন আপন মনে আওড়াতে থাকে। সন্ধ্যায় মিজানের ছোট ভাই শামিমকে দিয়ে ১০টাকা দামের একটি খাতা কিনে আনায় মায়া। খাতার পেজগুলো গুনে গুনে দেখে, অনেকদিন যাবে, ছোট বেলায় হাবিজাবি আঁকা-আঁকি করে খাতা যথাসময়ের আগে নিস্প্রাণ হয়ে যেত বলে মা কত বকেছে। জানালা দরজা বন্ধ করে নিভু নিভু হারিকেনটার আলো বাড়িয়ে চিঠি লিখতে বসে। ঢাল তলোয়ার রেডি করেও অনেক্ষণ থাকে; একটা শব্দও লেখা হয়ে ওঠে না। কিভাবে যে শুরু করবে আর সমাপ্তিটা যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। মায়া গণিতে কখনোই ভালো করেনি, স্কুল পরীক্ষায় যে ক'বার পাশ করেছে তাও ছিলো মাষ্টার মশাইদের করূণা, তারপরও সবচেয়ে কঠিন কোন অংক বুঝতেও এত সময় লাগেনি। রাত ২টা নাগাদ অনেক কষ্টে একটা চিঠি দাঁড় করায়, না করে উপায়ও ছিলো না, কাঁটাকাঁটির খেলা খেলতে খেলতে তখন লেখবার পাত্রও শেষ হয়ে গেছে; এক রাতেই খাতা শেষ--প্রথমবারের মত অনুভব করলো, তার মা বেঁচে না থাকাতে ভালোই হয়েছে। চিঠি লিখবার মহাযুদ্ধটা শেষ, এইবার ফলাফলটা এক নজরে দেখতে শুরু করে। প্রিয় অনেক কষ্ট করে চিঠি লিখছি, কি লিখব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তুমি কেমন আছো? আমি ভালো আছি। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবা না। সারাদিন দাদির সাথে গল্প করি, আর মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করি। জানো, আমি এরই মধ্যে পোলাও রান্না আর মুড়ি-ঘন্ট করা শিখেছি। রান্না করতে আমার ভালোই লাগে। আমাদের ছাগলের এবার দু'দুটা বাচ্চা হয়েছে। সারাদিন লাফালাফি করে বাড়ী মাথায় তুলে রাখে। অবসরে ওরাই এখন আমার খেলার সাথী। এবার বরই গাছে অনেক ফুল এসেছে; মা বলল তুমি বরইয়ের আচার পছন্দ কর; ভাবছি তোমাকে আচার করে পাঠাব। আর...! সকালে খামটি বেশ সুন্দর করে আটকিয়ে ঠিকানা লিখল এবং বার বার ঠিক আছে কি-না মিলিয়ে দেখে শামীমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-“যা ভাই চিঠিখানা পোষ্ট অফিসে দিয়ে আয়; রাস্তার ধারের বাক্সটিতে ফেলবিনা কিন্তু, একেবারে পোষ্ট অফিসের ভিতরে দিয়ে আসবি।” শামীম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো আবরো বললো, “চিঠি খানা যত্ম সহকারে নিয়ে যাবি কিন্তু, আর দেখতো ঠিকানাটা মিলিয়ে একবার।” “হ্যাঁ সব ঠিক আছে,” বলেই শামীম দৌঁড় মারল। “সাবধানে যাস্ কিন্তু।" যতক্ষণ না শামীম বাড়ীতে ফেরে মায়া কোন কাজেই মন বসাতে পারে না। তরকারি কাটতে গিয়ে বাম হাতের কড়ি আঙ্গুলটা কেটে ফেলে, তার থেকেও যে বড় ভুলটা করে তা হলো: মাংসে লবণের বদলে চিনি দিয়ে ফেলে। চিঠি পোষ্ট করার পর চিন্তা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন দশেক পার হলে শামীমকে পাড়ার ছেলেদের সাথে গুটি খেলার আসর থেকে ধরে এনে মায়া পাঁচ টাকার লোভ দেখিয়ে বলে, “যা ভাই একটু পোষ্ট অফিস থেকে ঘুরে আয় না।" “সকালে তো গেলাম একবার।” “এখন একবার যা, বলা তো যায় না!” “আচ্ছা, এবার এক টাকা বেশী দিতে হবে কিন্তু।” “হু," সম্মতি সুচক মাথা নাড়ে মায়া, “চিঠি নিয়ে সরাসরি আমার কাছে চলে আসবি।” মায়ার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে শামীম লাফাতে লাফাতে চলে যায়। ছয় টাকার আনন্দে তার আকাশ ছুঁতে ইচ্ছে করে। এভাবে কয়েকটি মাস কেটে যায়। ইতিমধ্যে শামীম লাল সাইকেল কেনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলে কোনো এক দুপুরে পিয়ন চিঠি দিয়ে গেলে মায়া বেশ যত্ম করে চিঠিখানা ব্লাউজের মধ্যে রাখে। এর থেকে নিরাপদ জায়গা আর কোথায় আছে! ভাবে, চিঠিটা সন্ধ্যার পর একাকী একান্তে পড়বে সে। থেকে থেকে বুকে হাত দেয় আর আকাশের দিকে তাকায়। সংসারের সব কাজ বেশ আনন্দের সাথে করে তবুও কোন কাজই যেনো যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ হয় না। সন্ধ্যার পর জানালা দরজা আটকিয়ে হারিকেনটা বিছানার একপাশে রেখে উপুড় হয়ে চিঠি পড়া শুরু করে মায়া। চিঠির খুব সাধারণ পরিচিত শব্দগুলোকেও সে গুরুত্ব সহকারে দেখে, আবিষ্কার করে নতুন এক উপযোগের। তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছাড়াই দিনগুলো চলে যায়। গতমাসে শামীম তার জমানো টাকার সাথে আরও কিছু যোগ করে একটি লাল সাইকেল কিনেছে। বর্তমানে সে সাইকেলে চড়ে পোষ্ট অফিসে যায়। এখন সে পরিপূর্ণ পিয়ন বনে গেছে। আশ-পাশের বাড়ীর চিঠিগুলো এনেও সে নিয়মিত বকশিস আদায় করে। প্রতিদিনই মায়া জানালা ধরে দাঁড়িয়ে শামীমের স্কুল ফেরার পথ ও আদিগন্ত শূন্য ভূমি দুই-ই এক সাথে দেখে। শামীম স্কুল থেকে ফেরার পথে পোষ্ট অফিস হয়ে আসে। দূর থেকেই শামীমের সাইকেলের আওয়াজ শোনা যায়। নতুন সাইকেল পেয়ে শামীম কারণে অকারণে বেল বাজায়। ওকে দেখে মায়া প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে। “কিরে চিঠিখানা ঠিক মত ফেলেছিস তো?” “ভাবি, তোমাকে আর কষ্ট করে চিঠি লিখতে হবেনা আর আমাকেও যখন-তখন পোষ্ট অফিসে দৌঁড়াতে হবেনা।" শামীমের উল্টো-পাল্টা কথার কিছুই বোধগম্য হয়না মায়ার। “মিয়া ভাই তোমার জন্য মোবাইল পাঠাইছে। এখন থেকে যা বলার মোবাইলে বলবা।" কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় মায়ার সকল অনুভূতি, বিষয়টি ঠিক কতখানি খুশি হবার বুঝে উঠতে পারে না সে। দিন দশেক কেটে যায় মোবাইলের খুব সাধারণ বিষয়গুলি আয়ত্তে আনতে। এরই মধ্যে কয়েকবার কথাও হয় মিজানের সাথে-খুব সাধারণ সাংসারিক কথা। মোবাইল নামক যন্ত্রটির কার্যক্ষমতায় প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয় মায়া, কিন্তু কোন স্বাদ খুঁজে পায় না সে। রক্ত মাংসের মিজানকে তার কাছে যন্ত্র মনে হয়। মোবাইলের আলাপচারিতায় অনুভব করে সে মানুষের কৃত্রিমতা, সংসারের বাহুল্যতা। তার ভালোবাসার আর ভালোলাগার ছাঁচে গড়া আমিত্ব কিছুতেই মানতে পারেনা জীবনের উল্টো এই সঙ্ঘাত। শুষ্ক মনে হয় চারপাশ। অনেক্ষণ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মায়া কিন্তু অসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করেনা। এই অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সে। জীবনের নির্যাস যেখানে নেই সেখানে কিসের বেচেঁ থাকা! তীব্র ঝটকার মত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ঘন্টা খানেক পর ফিরে এসে চিঠি লিখতে বসে। প্রিয়, না পারলাম না। সেদিনও পারিনি যেদিন মা মারা গেলেন, আমি শত চেষ্টাতেও ঝুলে যেতে পারিনি গাছের ডালে। আসলে, আমি বেঁচে থাকতে চাই, প্রচণ্ড ভাবে বেঁচে থাকতে চাই। তীব্র ভাবে অনুভব করতে চাই আমার প্রতিটি মুহূর্তের বেঁচে থাকাকে। আমার চিঠি পেয়ে আশ্চর্য হবে জানি, আমার বালিকা মনের হেয়ালিপনা দেখে হয়ত একটু হাসবে, কিঞ্চিৎ রাগ করবে, আবার এও জানি তুমি আমার অবস্থানকে অবহেলা করবেনা। আমার প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে থাকা যেমন সত্যি তেমন-ই সত্যি আমার ছাগল ছানার সাথে সখ্যতা, এবং সত্যি আমার তুমি। আমি তোমার বালিকা বধূ। তোমার আছে জগৎ আমার আছে তা অনুভবের বিস্ময়কর অনুভূতি। তোমাদের সংসারের চিরাচরিত স্রোতে নাইবা ভাসালে আমাকে। আমি না হয় রইলাম পড়ে একা, ইতিহাসের উল্টো স্রোতে। তোমার রইল বাহির, আমার ভেতর। প্রশ্রয় না দাও, বাধা দিওনা। মোবাইল কোন অন্যায় করেনি তবুও তার উপর আজ যে আচরনটা করলাম তা ভেবেই দগ্ধ হচ্ছি। তুমি আর কৈফিয়ত চেয়ো না দয়া করে। তোমার চিঠির অপেক্ষায় রইলাম। ইতি তোমারই মায়া। চিঠিটা শেষ করে নিজেকে খুব হালকা মনে হয় মায়ার। সকালে উঠে শামীমের হাতে ধরিয়ে বলে, “যা চিঠিটা পোস্ট অফিসে ফেলে আয়।” “মোবাইল?” “এখন থেকে তোর চাকরি আবার শুরু।" “আচ্ছা!” শামীম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। "সাবধানে যাবি কিন্তু!” |
Contact Us