NYnews52.com a e-news paper in Bengali and English with video excerpts.
Logo: NYnews52.com


সব গ্রন্থই পবিত্র
অতএব জিকির থামিয়ে বলো
এতোকাল ক'খানা পড়েছো।

সব ঘরই পবিত্র
অতএব তাণ্ডব থামিয়ে বলো
তুমি তার ক'খানা গড়েছো।



সাহিত্য/কবিতা

সভ্যতায় নারী: অনাদৃত অবদান

পূরবী বসু



বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
      কাজী নজরুল ইসলাম


মানব সভ্যতায় ও উদ্ভাবন ক্ষমতায় নারীর অবদান অনস্বীকার্য্য। তা সত্বেও সভ্যতা গড়তে নারীর ভূমিকাকে বরাবর অগ্রাহ্য করে আসছেন পৃথিবীর বড় বড় সব পুরুষ পন্ডিত ও মনীষীরা। পুরোপুরি অস্বীকার না করলেও তাদের অবদানকে লঘু করে দেখা হচ্ছে একটি প্রাচীণ ঐতিহাসিক রীতি। জগৎ বিখ্যাত প্রতিভাধর ব্যক্তিরা, যারা নারীর প্রতি বহু বিষয়ে অন্য সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক বেশী হৃদয়বান ও সহমর্মী, তারাও নারীর উদ্ভাবন ক্ষমতাকে স্বীকার করেন নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভ্যতা সৃষ্টির পেছনে নারীর ভুমিকাকে প্রায় অস্বীকার করেন। তিনি বলেন: ‘সাহিত্য কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধি ব্যবস্থায় মিলিয়ে আমরা যাকে সভ্যতা বলি সে হল প্রাণপ্রকৃতির পলাতক ছেলে পুরুষের সৃষ্টি’। আর ভলটেয়ার নারীর মননশীলতা আর বুদ্ধিবৃত্তির অস্তিত্ব স্বীকার করলেও পুরোপুরি অস্বীকার করেন নারীর উদ্ভাবনী শক্তিকে। তিনি বলেন : ইতিহাসে জ্ঞানবতী নারী খুঁজলেই পাওয়া যাবে, এমন কি পাওয়া যবে নারী-যোদ্ধার অস্তিত্বও, কিন্তু কোথাও নারী উদ্ভাবক পাওয়া যাবে না।“ তিনি আর-ও বলেন, “All the arts have been made by man, and not by woman.” ভলটেয়ার বলেন, নারীর কল্পনাশক্তি বলতে কিছু নেই। নারী–স্বাধীনতা বিরোধী সাহিত্য-তাত্ত্বিক Camille Paglia–এর মতে. “মেয়েদের হাতে যদি সভ্যতা ছেড়ে দেওয়া হতো, আমরা এখনো কুড়ে ঘরেই বাস করতাম।’’ Aristotle –এর উক্তি, ‘নারী হলো পৌরষ্যত্বহীন পুরুষ’। অ্যারিস্টটল বলেন, কিছু অক্ষমতার জন্যেই, মানে পুরুষ হয়ে উঠতে অক্ষম হবার কারণেই নারীদের নারী হয়ে জীবন কাটাতে হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, ‘The woman is as it were an impotent male, for it is through a certain incapacity that the female is female, being incapable of concocting the nutriment in the last stage into semen’. নারীর মেধাশূন্যতা সম্পর্কে জাঁ-জাক রুশো বলেন, “বিমূর্ত ও প্রাকল্পনিক সত্য অনুসন্ধান, বিজ্ঞানের নীতি ও সূত্র উদ্ঘাটন, যা কিছুতে দরকার পড়ে চিন্তার সাধারণীকরণ, তা নারীর আয়ত্ত্বের বাইরে। তাদের বিদ্যা হবে ব্যবহারিক, তদের কাজ হবে পুরুষের আবিষ্কৃত সূত্র প্রয়োগ করা, এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেসব পর্যবেক্ষণ করা, যা ভিত্তি করে পুরুষ রচনা করবে সাধারন সূত্র।“ জন রাসকিন-এর মতে, “নারীকে জ্ঞান দেওয়া যাবে না জ্ঞান হিসেবে, নারীদের জ্ঞান দিতে হবে এমনভাবে যাতে নারী শুধু অনুভব ও বিচার করতে পারে। নারীর মাথাটি নষ্ট করে দিয়ে বুকের ভেতর সৃষ্টি করত হবে স্যাঁসেঁতে ভাবালুতা। নারীর জ্ঞান নারীর গর্ব বা বিশুদ্ধির জন্যে নয়। তা শুধু তাঁকে দয়াবতী করে তোলার জন্যে। রাসকিনের মতে, ‘মেয়েদের বিজ্ঞাণ শেখানোর দরকার নেই, তাকে শুধু বিজ্ঞানের দু-একটি খবর জানানো যেতে পারে। নারীকে জ্ঞানের ‘অভিধানে’ পরিণত করার দরকার নেই, তবে তাঁকে করে তুলতে হবে ভাবালুতার ঝর্ণাধারা। নারীকে ধর্মতত্ত্ব শেখানো যাবে না, এটা বিশেষভাবে বারণ। নারীকে ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। তবে তাঁদের ভরে তুলতে হবে ধর্মভাবে যাতে তারা হয়ে ওঠে বিনীত ও করুণাময়ী”। রবীন্দ্রনাথ-ও বলেছেন, “ইয়ুরোপের সভ্যতা যত অগ্রসর হচ্ছে স্ত্রীলোক ততই অসুখী হচ্ছে”। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, নারীকে হতে হবে নারী; কল্যাণী। পুরুষ হবে কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, শাসক, গণিতজ্ঞ, প্রকৃতি অর্থৎ স্রষ্টা বা প্রভু। ফলে দেখাই যাচ্ছে, সভ্যতায় নারীর অবদানকে সচেতনভাবে অস্বীকার-ই শুধু করেন নি জগৎ বিখ্যাত পন্ডিতরা, যাচাই না করেই নারীর মনন, মেধা, সামগ্রিক ক্ষমতা সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর ও নেতিবাআচক মন্তব্য করেছেন।। আর সেটা করেছেন পূবের-পশ্চিমের প্রায় সকল মণীষীই।

সভ্যতার শুরু থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারীর প্রকৃত অবদান স্বীকৃতি লাভ করেনি। এর জন্যে সবচেয়ে বেশি দায়ী ইতিহাসবেত্তারা যাঁরা প্রায় সকলেই পুরুষ এবং যাঁরা সুচতুরভাবে এবং বেছে বেছে নারীর অবদানকে ইতিহাসের পাতা থেকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলেছেন। সভ্যতার কোন ক্ষেত্রেই তাঁদের স্থান দেননি। পুরুষের জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, আবিস্কার যে বিস্তৃতির সঙ্গে ও সপ্রসংস দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে, নারীর অবদানকে তেমনি অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পুরুষতন্ত্র এড়িয়ে গেছে।

নারীর প্রতি এই ধরণের বৈষম্য দূর করার জন্য জাতিসঙ্ঘ বিস্তারিত সনদ তৈরি করেছে। তাঁর ওপর ভিত্তি করে দেশে দেশে, বাংলাদেশেও, নারী উন্নয়নের নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এখন যা দরকার তাহলো সেসব নীতিমালার সুষ্ঠু প্রয়োগ।

সৃষ্টির গোড়া থেকে নারীর অবদানকে বার বার যেমন করে মুছে ফেলা হচ্ছে, অস্বীকার করা হচ্ছে তাঁর মূল্যবান অর্জণ, তেমনি করে ভবিষ্যতেও যাতে অস্ব্বীকার করতে না পারে সেজন্যে নারীর জন্যে প্রয়োজন একটি নিজস্ব সামাজিক সত্তা, আদর্শিক ভিত্তি, একটি অবিরাম আন্দোলণের অস্তিত্ব, পোক্ত ক্ষমতার কাঠামো। সেটি দরকার পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, বৃহত্তর পৃথিবীতে, সর্বত্র; সেখানে নারী শুধু কারো মাতা নয়, কন্যা নয়, ভগিনী নয়, প্রেয়সী নয়, স্ত্রী নয়, সেবিকা নয়, দাসী নয়; যেখানে সে একজন পূর্ণ মানুষ, - এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র সত্তা, এক নারী। মানুষেরই অন্যতম রূপ। অথচ পুরুষ নয়, পুরুষের অধীন নয়, পুরুষের পেছনে নয়। পুরুষের পাশে। পুরুষের সঙ্গে। একত্রে। হাত ধরে। সোজা মাথা উঁচু করে দন্ডায়মাণ মানব সন্তান। স্বাধীন । পুরুষ যেমন নারীর অধীন হবে না তেমন নারীও হবে না পুরুষের অধীন। এই সত্তা, এই তেজ, এই রূপ, স্বকিয়তা, দৃঢ়তা ও স্বাধীনতা নিয়ে যেদিন নারী পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবে সেদিনই ঘরের অভ্যন্তরে ও ঘরের বাইরে বৃহত্তর পৃথিবীতে নারীর সামগ্রিক অবদান পুরুষের নানামুখী কর্মকান্ড, অর্জণ ও অবদানের মত-ই স্বীকৃত হবে।

এতদিন ধরে সভ্যতায় নারীর অবদানের ইতিহাস রচনা নির্ভর করত পুরুষের ইচ্ছা বা দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর, করুণার উপর, বিবেচনার উপর। এতোদিন ধরে এটি ছিল নির্ভরতার ইতিহাস। ওখানে নারীএ স্থান ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো। তাঁকে হা-পিত্তেশে তাকিয়ে থাকতে হতো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক পুরুষের মুখের দিকে। পুরুষের দয়া-মায়া-দাক্ষিন্য, বিবেচনা, মানবতাবোধ কিংবা স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা ও খামখেয়ালির ওপর। আধুনিক সভ্যতার অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীর ভেতর এই অসম অবস্থা পরিবর্তনের তীব্র বাসনা সঞ্চারিত হতে শুরু করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্নতি হয়েছে ততই দেহ বা পেশী শক্তির গুরুত্ব কমেছে। সেই সাথে সমাজে, সংসারে দেহশক্তির বলে বলীয়াণ প্রবল ক্ষনতাধর পুরুষের যে আধিপত্য এতকাল ছিল তাতেও ভাঙ্গন ধরতে শুরু করেছে। নারীর এখন উপযুক্ত সময় দলবদ্ধ হয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও মানুষের শুভ বিবেককে নাড়া দিয়ে, সহমর্মী পুরুষদের পাশে নিয়ে আপন অধিকার ও অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নেয়া।



[২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় কথা সাহিত্যিক পূরবী বসুর "সভ্যতা নির্মাণে নারী" শিরোনামে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে এই প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে।--সম্পাদক]


Contact Us