NYnews52.com a e-news paper in Bengali and English with video excerpts.
Logo: NYnews52.com


সময়কে এইভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো
করে প্রত্যেকের হাতে
জিলিপির মতো
তুলে দেয়া যায়



সাহিত্য/কবিতা


আমার বাবা বুদ্ধদেব বসু



মীনাক্ষী দত্ত



[এই লেখাটি আমার বাবা বুদ্ধদেব বসুর ৯৯ তম জন্মদিনে তাঁর কয়েকটি বিচ্ছিন্ন স্মৃতি --বলতে পারেন স্ন্যাপ শট।]

প্রচলিত অর্থে সাংসারিক বাবা একেবারেই ছিলেন না। কী বাজার, কী রান্না, কী বাড়ি, কী ঘর, ছেলেমেয়ের স্কুল বা হোম ওয়ার্ক, আত্মীয় স্বজন--এসব কিছু নিয়েই তিনি মাথা ঘামাতেন না। আমাদের জীবন যে মসৃণ ভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে চলতো তার কারণ তাঁর অসামান্যা স্ত্রী, আমার প্রতিভাময়ী মা, প্রতিভা বসু। তবু আমাদের তিনভাইবোনের কাছে বাবা শ্রেষ্ঠমানুষ, শ্রেষ্ঠ পিতা এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বাবার মনোযোগ পেতে আমাদের শৈশব থেকে বালিকাত্বে পৌঁছতে হয়েছিলো। শিশু যখন বই পড়তে শিখেছে, তার কৌতুহল হতে শুরু করেছে অন্তহীন, স্পষ্ট মতামত হচ্ছে, তখন থেকে বাবার সঙ্গে তার বন্ধুতা। হয়তো সন্ধ্যায় আঙুল ধরে হাঁটতে নিয়ে যাবেন, রাস্তার কোণায় বকুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পকেটের রুমাল বার ক'রে বলবেন মার প্রিয় ঝরা বকুল কুড়িয়ে নিতে, আকাশের তারা চেনাবেন--‘ঐ দেখ কালপুরুষ, আর ঐ যে সপ্তর্ষী।’ বাবার প্রথম আগ্রহের বিষয় অবশ্য ছিলো সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের মতো সর্বগামী ছিলো না তাঁর মন। তিনি যে খুব প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন তাও বলতে পরবো না। মা ভালোবাসতেন বাগান করতে, ভালোবাসতেন পশু পাখি, বাড়ি জমি ঘর সংসার, রান্নাবান্না। নাগতলায় মা যখন বাড়ি করলেন তখন বাবার ঘরটি বিশেষ যতেœ বানিয়েছিলেন। দক্ষিণের দেয়ালে প্রায় পুরোটাই জানালা, পূব দক্ষিণ কোণে দেয়ালে জায়গা লেখার টেবিল পাতার জন্য। পুবেও দেয়াল কম, বিরাট দরজা উঠোনে খুলছে, দু’পাশে জানালা। উঠোনে গেটের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় কতো রকম ফুলের টব। বাবা লিখতে লিখতে হয়তো একটু উঠবেন, দাঁড়াবেন গিয়ে আকাশের তলায়, ফুলের সভায়! কোথায় কী! মা বাড়ি ক'রে সাজিয়ে গুছিয়ে তবে বাবাকে আনলেন। বাবা পুবের দরজা সম্পূর্ণ আটকে পাতলেন বই-এর শেলফ, তার পাশে লেখার টেবিল। বোবা, সাদা দেয়াল সামনে ছাড়া তাঁর লেখা হতো না, চাঁদ, ফুল, তারা তাঁকে তেমন মুগ্ধ করতো না।
মধ্যবিত্ত জীবনের স্টিরিওটাইপে ফেলা যেতো না বাবকে। আমাদের স্কুলের পড়া নিয়ে কখনো প্রশ্ন করেছেন বলে মনে পড়ে না। হয়তো জিগেস করেছেন ‘খাপছাড়া’ বেশি ভালো লাগে, না ‘আবোল তাবোল।’ সাত বছরের বালিকাকে হয়তো পড়ে শোনাবেন ব্লেকের ‘টাইগার টাইগার বার্নিঙ ব্রাইট। ইন্ দ্য ফরেস্ট অব দ্য নাইট’ অথবা দেখাবেন রেনোয়াঁর ছবির এ্যালবাম। নিয়ে যাবেন চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখাতে, ‘গোল্ডরাশ,’ ‘দ্য কিড’--এসব। ডিজনির ‘পিনোকিও’ আর ‘ক্যাম্বিনো’ দেখেছিলাম মনে আছে। আমার নয় বছরের জন্মদিনে বাবা উপহার দিয়েছিলেন ‘যোগাযোগ।’ রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ নয় কেন, নব্বই বছর বয়সেও কি বোঝা সহজ? তাও পড়েছিলাম, কুমুকে একেবারেই ভালো লাগেনি, আজও আমাদের বাড়িতে বলা হয় মিমি ‘যোগযোগ’ পড়ে বলেছিলো, “কুমুটা কী রে!” ‘যোগাযোগ’ আফটার অল বাংলা, চোদ্দো বছরের জন্মদিনে পেলাম থান ইটের মতো ডস্টেভস্কির ‘দ্য ইডিয়ট।’ সে তো দু’চারপাতা উল্টিয়েই রেখে দিলাম। বাবা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন মেয়ে আসলেই ইডিয়ট। ভাগ্যক্রমে এরপর থেকে এ্যব্রিজড ক্ল্যাসিকস কিনতে শুরু করলেন, ‘লা মিজারেবল,’ ‘প্রাইড এ্যান্ড প্রেজুডিস,’ ডিকেন্সের নানান উপন্যাসে বই-এর তাক ভরে উঠলো। পড়ে যাও, পড়ে যাও শুধু, তাহলেই বাবা খুশি। নিজের কাজে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিলেন বাবা। কলকাতায়, বাড়িতে থাকলে রোজ আট/দশ ঘণ্টা লিখতেন। সন্ধেটা থাকতো আড্ডার জন্য। স্নান সেরে সুন্দর, সুবেশ হয়ে বসার ঘরে নিজের চেয়ারে এসে বসতেন বাবা। কলকাতা তখন সত্যিই ছিলো সাংস্কৃতিক রাজধানী, কবিরা মুক্ত ও অহঙ্কারী, মিডিয়া বা পুরস্কারের যাচক নন। আসতেন লেখক, চিত্রকর, গায়ক, চিত্রপরিচালক--মার সূত্রে অভিনেতা অভিনেত্রী। কতো রাত অবধি চলতো আড্ডা-হাসি-গান-তর্ক, কখনো বা নাটকের রিহার্সেল। মতানৈক্য বাবা শুধু সহ্য করতেন তাই নয়, স্বাগত জানাতেন। সেটা ছিলো তাঁর চিন্তার ব্যায়াম, মননের টনিক। নিজের লেখার পেছনে যতো সময় দিতেন বাবা, প্রায় ততোই সময় দিতেন অন্যদের লেখার পেছনে। তিনি একাই ছিলেন এক ‘রাইটার্স ওয়ার্কশপ’ বা ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিঙের ক্লাশ--সমর সেন থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত সকলেই যে ক্লাশের ছাত্র। কতোবার ক'রে লেখাতেন একএকজনকে দিয়ে--এখানে শব্দ বদলাও, ওখানে ছন্দ। সাতবার আটবার করে লিখে তবে লেখাটি তাঁর মনোনীত হতো এবং ‘কবিতা’ পত্রিকায় স্থান পেতো। রবীন্দ্র পরবর্তী পঞ্চকবি, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত--একসঙ্গে, এর মতো বাংলা কবিতার এখনো কিছু ঘটেনি, এবং এর মধ্যে একজন, বুদ্ধদেব বসু, নিলেন কবিদের পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করানোর দায়িত্ব, তাঁদের উৎসাহ দিয়ে লেখানো, কবিতা ছাপা, তাঁদের বই নিজের পয়সায় ছাপা, তার সমালোচনা লেখা, সাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো প্রধান লেখক আছেন কি যিনি অন্য লেখকদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এমন পরিশ্রম করেছেন! আর তাঁর নিজের লেখা! কবিতা ছাড়াও, প্রবন্ধ, সমালোচনা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, ছোটোদের গল্প, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, তার উপর সম্পাদনা, শিক্ষকতা। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। শুনেছি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে এক কাঠের ফলকে তাঁর নাম ছিলো রেকর্ড নম্বর পাবার জন্য, কিন্তু আশির দশকে আমরা যখন গেলাম, দেখতে পেলাম না, হয়তো একাত্তরের যুদ্ধে ভাঙচুর হয়েছিলো। তাঁর বি, এ এবং এম, এ পরীক্ষার খাতাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত ছিলো অনেকদিন, অধ্যাপক প্রফুল্ল ঘোষ (যিনি পরীক্ষক ছিলেন) নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরিজি সাহিত্যের ছাত্রদের পড়ে শুনিয়েছিলেন। প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে বাবা কলকাতার রিপন কলেজে চাকরি নিয়ে চলে আসেন গুরুজনদের আই, সি, এস-এর জন্য প্রস্তুত হওয়ার অনুরোধ অগ্রাহ্য ক'রে। প্রথম থেকেই তিনি স্থির করেছিলেন তিনি হবেন পুরো সময়ের লেখক, তার জন্য অধ্যাপনাই একমাত্র পেশা যা নেওয়া যায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘মর্মবাণী’ বেরোয় চোদ্দো বছর বয়সে। রিপন কলেজের চাকরি কিন্তু তিনি খুব বেশিদিন করেননি। চাকরি ছেড়ে দেবার পর তাঁকে বেশ আর্থিক অনটনে পড়তে হয়েছিলো। সংসার চালানোর জন্য লিখেছেন দেবসাহিত্য কুটির সিরিজের ডিটেকটিভ উপন্যাস, ‘ছায়া কালো কালো,’ ‘ভূতের মতো অদ্ভুত,’ ‘কালবৈশাখীর ঝড়,’ ইত্যাদি। বিক্রি করেছেন বই-এর কপি রাইট। সারারাত লিখে সকালে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেছেন প্রকাশকের দরজায়। কিন্তু তখনো চালিয়ে গেছেন ‘কবিতা’ পত্রিকা, ছাপিয়ে গেছেন অন্যান্য কবিদের বই। বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশের কথা বলবো। তখন তো কেউ জীবনানন্দর কবিতা ছাপতেন না। বাবা যখন ঢাকা থেকে ‘প্রগতি’ বার করতেন তখন থেকেই ছাপাতেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা, তারপর ‘কবিতা’য়। একএক সংখ্যায় সাতটি আটটি করে কবিতা ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ, তখন পূর্বপাকিস্তান, থেকে তরুণ কবিরা লেখা পাঠাতেন--শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ--সবার কবিতাই ‘কবিতা’য় স্থান পেয়েছে। আমাদের কৌতুহল উদ্রেক করতো ঢাকায় বাংলা কাব্যবিপ্লবের খবর। সেখানে এক নাগরিক, আধুনিক, সংশয়ী মানসের উন্মেষ ঘটছিলো যার উজ্জ্বলতম প্রতিনিধিরা ছিলেন ‘কবিতা’র কবি। বস্তুত, ‘কবিতা’য় ছাপা না হওয়া পর্যন্ত কেউই স্বীকৃতি পেতেন না। বাবা কখনো বেদীর উপর বসে আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেননি। তিনি ছিলেন সমতা ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাড়িতে একটা খোলামেলা স্বাধীনতার হাওয়া খেলা করতো। বন্ধুরা ছিলো আমাদের বাড়িতে স্বচ্ছন্দ। বাবা ছিলেন বিশ্বাসী, সরল ও অকপট। জীবনে তিনি মিথ্যা উচ্চরণ করনেনি। তাঁর সারল্যের একটা গল্প বলি। আমার এক কলেজের বন্ধু ছিলো, মৃণাল। সে আমার কাছে প্রায়ই আসতো আড্ডা মারতে। আমাদের পাড়ায় একটা মনোহারি দোকান ছিলো ‘বড়াল ব্রাদার্স’--দুই ভাই চালাতো। শ্যামলা রঙ, রোগা--বাঙালি ছেলেরা যেমন হয়। মৃণালও ওই ধরণের দেখতে। একদিন মৃণাল এসে কড়া নেড়েছে, বাবা দরজা খুলে দিয়েছেন। মৃণাল বলেছে, “মীনাক্ষী আছে?” বাবা তাকে বসিয়ে ভেতরে গিয়ে মাকে বলছেন, “বড়ালের ছেলেটি মিমিকে খুঁজছে।” বড়ালের ছেলে আমাকে খুঁজছে শুনে কৌতুহলী হয়ে গিয়ে দেখি, ওমা! মৃণাল। তারপর থেকে কাউকে চিনতে ভুল হলেই বাবাকে শুনতে হতো--“বাব! আবার বড়ালের ছেলে!” একবার মা কলকাতার বাইরে গেছেন আমার ভাইকে নিয়ে, আমার তখন বিয়ে হয়ে গেছে, তাই বাড়িতে শুধু বাবা আর আমার ছোটো বোন রুমি। সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি বাবা চিন্তিত মুখে বাইরের ঘরে ব'সে আছেন, আমাদের দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “এসেছিস! দ্যাখ তো, কী বিপদে পড়েছি, রুমির জ্বর হয়েছে।” কোথায় রুমি? রুমি শোবার ঘরে, কিন্তু তার এতো বন্ধু এসেছে যে বাবা ঢুকতে পারছেন না। তার কদিন আগে রুমি আর নবনীতা (দেব) যাদবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে ঘুরে এসেছে দিল্লির ইয়ুথ ফেস্টিভাল থেকে। তখন তো মেয়েরা এঞ্জিনিয়ারিঙ পড়তো না, তাই ছেলেদের দল রুমি আর নবনীতার সঙ্গে ভাব করতে পেরে মহাখুশি--সবাই দঙ্গল বেঁধে এসেছে। আমি গিয়ে তাদের হটালাম। রুমি মাঝে মাঝেই ফোনের তার টেনে নিয়ে বাবার টেবিলের তলায় বসে নবনীতার সঙ্গে তাদের প্রেমজীবনের নানান সমস্যার আলোচনা করতো যাতে অন্যকেউ শুনতে না পায়। বাবা তো লেখায় মগ্ন, কান দেবেন না, আর, রুমি ভাবতো, বাবা ও-সব বোঝেন না। পরে বাবার একটি উপন্যাসে তার দু’চারটে মোক্ষম ডায়ালগ শুনে রুমির খুব রাগ হয়েছিলো। ‘বিপন্ন বিস্ময়’ উপন্যাসে আমাদের অনেকের জীবনই ধরা আছে।

আমরা ছোটো বেলায় পাড়ার এক স্কুলে পড়তাম। উঁচু ক্লাশে উঠতে বাবার সঙ্গে গেলাম গোখলে মেমোরিয়ল স্কুলে ভর্তি হতে। বাবার লেখা ইংরিজি পাঠ্যপুস্তক ছিলো--‘ইংলিশ ফর বয়েজ এ্যান্ড গার্লস’--বলছি বাহুল্য টাকার জন্য লেখা। স্কুলের প্রধানদের কাছে বেশ পরিচিত ছিলেন তিনি। গোখলে স্কুলের প্রিন্সিপাল বললেন, “আপনার মেয়ে, কী আর দেখবো। ঐ একটা নিয়ম রক্ষার জন্য পরীক্ষা নিচ্ছি।” বলে তিনি আমাকে একটা চিঠি লিখতে দিলেন। ‘প্রিয়’ শব্দটির ইংরিজি বানান লিখলাম ‘উববৎ'। পরীক্ষা ফেল, বাবার খুব অপমান হলো। সেই সময় একমাস আমাকে পড়িয়েছিলেন, বারো চোদ্দো ঘণ্টা করে পড়তাম। তারপর বাবা পরীক্ষা নিলেন, বাংলা ও ইংরিজি। পাশ কললাম বলে খুব খুশি, সেই থেকে আমি হলাম বাবার সেক্রেটারি, মাইনে দু’টাকা। ডায়োসেশনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ভর্তি হলাম। একমাসে বাবার কাছে সারাজীবনের জন্য তৈরি হয়েছিলাম বললে অত্যুক্তি হবে না। শিক্ষকতা বাবার আর একটি বিশেষ ক্ষমতা ছিলো। যাদবপুরে যখন তুলানামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু করলেন তখন বাড়ি ছাত্রছাত্রীরা ভরে রাখতো। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, নবনীতা দেব (সেন), দিব্যেন্দু পালিত, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, আমিয় দেব, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এঁরা সব তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম দিকের ছাত্রছাত্রী। একসঙ্গে পড়াচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত--এমন সুযোগ কি বারবার আসে? বাঙালী পাঠককে সাহায্য করেছেন বাবা ইয়োরোপিয় কবিতা বাংলায় পড়িয়ে। বোদলেয়র, রিলকে, হ্যেল্ডরলি, ব্লেক, পাস্তারনাক অনুবাদ করেছেন। লিখেছেন মেঘদূতের উপর যুগান্তকারী প্রবন্ধ, অনুবাদ করেছেন মেঘদূত। তিনি ছিলেন চির অগ্রসরমান, নতুন নতুন সম্ভাবনার দরজা তাঁর সামনে খুলে গেছে। ঘুরেছেন পৃথিবীর নানান দেশে, পড়িয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বন্ধুত্ব করেছেন সারা পৃথিবীর লেখক ও কবি কূলের সঙ্গে। হেনরি মিলারের সঙ্গে বাবার গাঢ় বন্ধুতা ছিলো। একবার বি, বি, সি থেকে এক সাক্ষাৎকারে হেনরি মিলারকে প্রশ্ন করা হয়--এ বছর (১৯৫৪) আপনার জীবনের সবচাইতে বিশেষ ঘটনা কি? মিলার বলেন, “বাঙালি কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয়।”

শেষের দিকে কাজ করছিলেন মহাভারত নিয়ে। ‘মহাভারতের কথা’-র প্রথম খণ্ড লেখা হয়েছে, দ্বিতীয় খণ্ড শুরু করবেন, এই সময়ে অকারণে, অকালে তাঁর ডাক এলো। আত্মজীবনীও ২০২-এর দরজায় এসে ঠেকে গেলো, আমরা বঞ্চিত হলাম আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সময়ের ইতিহাস থেকে। বাবার কথা যখনই ভাবি মনে পড়ে তাঁর হাসি, যার শব্দ, লোকে বলতো, গড়িয়াহাটের মোড় থেকে শোনা যায়, তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় হাতে কলম নিয়ে কাগজের উপর ঝুঁকে থাকা তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর মুখ। কতো ভোরে ঘুম থেকে উঠছি, দেখছি সারারাত লিখে আলো নিভিয়ে বাবা শুতে যাচ্ছেন। সেই ভাবেই তাঁকে মনে রেখেছি, মনে রাখতে চাই।
('শব্দগুচ্ছ', ৩৮তম ইসু থেকে)



কবিতা

তমিজ উদ্দীন লোদী


দু'টি কবিতা

হিপনোটিজম



আমাকে শেখাচ্ছ তুমি হিপনোটিজম
অথচ লটবহরসহ সেঁধিয়ে যাচ্ছি অনন্ত গহ্বরে
অন্তর্গত অপভাষগুলো,ঈর্ষা ও ভৎসনাগুলো দৌড়চ্ছে অবিরাম
স্নায়বিক দুর্বলতাগুলো সেধে আসছে পিছু পিছু।

আমি জানি হিপনোটিজম ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই
মরচে-লাগা সকল অস্ত্রে স্থবিরতা,ধূলো
সন্তর্পণে পা ফেলছে ভয়,ইতিহাস কাহিণী হয়ে ঘুরছে ইথারে
কী এক অজানা স্রোত-বাতাসের স্রোত বয়ে যায় আমাদের
আরামে ও অগাহনে।

বিশ্বায়নের রাজপথগুলো দীর্ঘ-দীর্ঘতর
যা আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে পার হই-ঘষটে ঘষটে পার হবার কসরত করি
তোমার অনুমোদন পাবার জন্য হা-পিত্যেশ করতে করতে অবসন্ন হই
শুধু আমি চাই-খুব ভালো করে চাই হিপনোটিজম।

আমি জানি সবকিছু পাথর নয়
পাথর ও আকরিকের বাইরে একটি বিশাল বোধের আকাশ আছে
সেখানে কিছু অভীপ্সা দৌড়চ্ছে কতকাল
কিছু প্রতীক্ষা ছায়া দিঘিতে খুব শ্রান্ত হয়ে আছে আর
মৃত্যুভয়হীন কিছু আকাঙ্ক্ষা বুড়োসুড়ো গাছ হয়ে আছে।

তুমি আমাকে খুব দ্রুত শিখিয়ে দাও
বাষ্প ও উত্তাপের বাইরে আমি খুব স্নিগ্ধ, স্নিগ্ধ কাটাতে চাই।


বৃষ্টির মতো সুন্দর এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়



বৃষ্টির মতো সুন্দর এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়
একটি পাটকিলে সূতো কি ঘুড়ি খানিকটা কাত হয়ে উড়ছে আকাশে
আর অনেক ক'টি ফড়িং এসে জড় হয়েছে আমাদের উন্মুক্ত উঠোনে।

বুকের ভেতরে একটি শুভ্র পাখি কেবলি ডানা ঝাপটায়
শৈশবের সবুজ ঘাস তার শিশির-সমেত লাফিয়ে ওঠে
বিশাল কচু পাতা থেকে গড়িয়ে নামে জল
বৃষ্টি পতনের শব্দে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে টিন-ঘেরা চাল আর
অনেকগুলো নৈঃশব্দ্য!

তবু কেন খুব তুচ্ছ কারণেই হৃদয় থেকে এমন রক্তক্ষরণ
যাবতীয় জাড্য এসে জড় হয় অনাহুত আগন্তুক হয়ে
দীর্ঘ জীবনের রপ্ত করা সমস্ত ভদ্রতা ও পরিশীলনের গালে চপেটাঘাত করে
কারা খুব সেডিষ্ট আনন্দে মেতে ওঠে এখানে ওখানে।

কারা খুব অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলে পাখিদের নীল ডানা, খয়েরী সকল পালক।

একমাত্র আরাধনা ছিল সুন্দরের
তবু অমার্যিত কিছু বরাহ এসে কলুষিত করে যায় আমাদের তকতকে নিকোনো উঠোন।

চাঁদে কলঙ্ক ঢেলে ওরা খুব উন্মত্ত, হেসে হেসে খুন হয়ে যায়।




Contact Us