Back to Front Page বেলাল বেগের অন্যান্য লেখা: |
মুক্তচিন্তা কিসের এতো কথা বেলাল বেগ সামাজিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সন্ধানে
মানুষের সমাজের মত বাংলাদেশে এখন প্রকৃতিও ধ্বংসের কবলে পড়েছে। পানিতে আর্সেনিক, জমিতে বিষ, দূষিত বাতাস, নষ্ট নদী । সাপ-ব্যাঙ, মাছ-পাখী, বন্য জীব-জন্তু, বৃক্ষ, তরু-লতা-গুল্ম, সবই বিলুপ্তির পথ ধরেছে। ধন-ধান্য-পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা-সোনার বাংলার 'সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা' রূপটি আমাদের বংশধররা আবার দেখতে পাবে কি? প্রশ্নটি পরিবেশের নষ্ট ভারসাম্য বিষয়ক হা-হুতাশ নয়; প্রশ্নটি জাতি হিসাবে আমাদের বাঁচা-মরার সংগে জড়িত। মানুষ প্রকৃতির কোটি কোটি প্রাণী প্রজাতির একটি । উদ্ভিদজগৎ, প্রাণী জগৎ, ভূমন্ডল, আবহাওয়া এ সবকিছু নিয়ে প্রকৃতি। বস্তুর অনু-পরমানু ও প্রাণীদেহের কোষের মত, প্রকৃতির সবকিছু একে অন্যকে জড়িয়ে একাকার হয়ে বেঁচে থাকে। জীবন প্রবাহে কোন বাঁধা এলে তা সুঁই ফুটার মতই খবর হয়ে যায় সমস্ত প্রকৃতিতে। উষ্ণমন্ডলীয় জলবায়ু, নদী বিধৌত উর্বর ভূমিযুক্ত বাংলাদেশের মানুষের হাতে প্রকৃতি তার অঢেল সম্পদ ঢেলে দিয়েছিল। ষড় ঋতুর বৈচিত্র বাংলার মানুষকে প্রকৃতির প্রেমে মত্ত রেখেছিল। এই প্রেম আসলে উদ্ভিদ ও জীবের বাঁচার শর্তে অভিন্নতার অনুভব মাত্র। এই বোধটি সহজিয়া জীবনদর্শন হয়ে বাঙালীর চৈতন্যে স্থান করে নিয়েছিল। বাঙালী চরিত্রের যে ধর্মনিরপেক্ষতা সেটাও এই সহজিয়া জীবন দর্শনের অঙ্গ। সহজিয়া দর্শনে জীবন প্রেমময়; মানব স্বভাবের ভিতরেই লুক্কায়িত আছে প্রকৃতির গুঢ় রহস্য। অতএব খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সংগে সংগে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াও বাঙালী জীবনের লক্ষ্য। মানুষ ও মনুষ্যত্বের জয়গান সব মানুষের ভিতর ছড়িয়ে গিয়েছিল বলেই বাঙালীর স্বাভাবিক জীবন যাত্রা হয়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক। ‘‘ আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসেনি কেহ অবনী পরে, প্রত্যেকের তরে প্রত্যেকে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’’ সমাজতন্ত্রের এমন সুন্দর সংজ্ঞা আর কোন জাতির আছে কিনা কে জানে। যুগে যুগে ধর্ম ছিল শাসকের ক্ষমতা দখল ও রক্ষার কূটকৌশল। হিন্দু ও মুসলমান, প্রধানতঃ এই দুই সমপ্রদায়ের মানুষ নিয়েই ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতীয় জনগন। তাদের অনুপাতে ক্ষমতাদখলকারী বৃটিশ সংখ্যায় ছিল একেবারেই নগন্য। কিন্তু অসৎ কুটকৌশলে অপ্রতিদ্বন্ধী ধূর্ত বৃটিশ শাসকেরা ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে প্রধান জনগোষ্ঠীদ্বয়কে একে অপরের শত্র“তায় লিপ্ত রেখে নিজেদের শাসন ও শোষণ নিরাপদ রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এই অসৎ রাজনীতির খপ্পরে পড়ে বাঙালী তার সহজিয়া জীবন ধারা থেকে ছিটকে পড়ল। ধর্মের নেশায় উন্মক্ত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান বাঙালী ভুলে গেল সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। তারা একে অপরের বুকে ছুরি বসাতে লাগল যতক্ষন না দেশ ভাগ হয়ে তারা বিচ্ছিন্ন হল। হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা বাঙালীকে তার মানবতাবাদী জীবন দর্শনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে অধঃপতনের নিকৃষ্টতম নরকে নিক্ষেপ করেছিল। পূর্ববাংলায় দেশভাগ শাপে বর হল। স্বজাতি হিন্দুর স্থলে স্বধর্মীয় পাকিস্তানী মুসলমানের আধিপাত্য কায়েম হলে বাঙালীরা এই প্রথম হাড়ে হাড়ে অনুভব করল, ধর্মে এক হলেও জাতি হিসাবে তারা ভিন্ন। এই বোধ যতই গভীর হতে থাকল, ততই তারা অতীতের জাতীয় মহত্বগুলি অনুভব করতে থাকল। এর ফলে জাতীয়তাবোধ নামে নিজেদের মধ্যে এমন এক আত্বীয়তার বন্ধন গড়ে উঠল যে একাত্তরে বাঙালি পরস্পরের জন্য নিজের জীবনসহ সর্বস্ব বিলিয়ে দিল। জাতীয়তাবাদের বিজয় হল এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ চূড়ান্তভাবে পরিত্যক্ত হল। বাঙালি জাতি ইতিহাসে তার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করল ১৯৭১ সালে। কিন্তু তখনো ধনবাদী ও আধিপাত্যবাদী শোষকের থাবা থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ নিরাপদ ছিল না। ধর্মাস্ত্র ব্যবহারকারী শত্রুরা ১৯৭৫ সনে আবারো বাংলাদেশ কবজা করে নিয়ে ধর্মরাক্ষসদের বাঙালির ঘাড়ে তুলে দেয়। তারপর ৩৫ বছর পার হল। মাত্র এই সেদিন, বাঙালীরা শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও তার দোসর মধ্যপ্রাচ্য পালিত ধর্মীয় রাক্ষসগুলিকে জাতির ঘাড় থেকে ছুঁড়ে ভূতলে ফেলে দিতে সমর্থ হল। মূহূর্তেই যেন দেহ-মন বিবশ করা শীত শেষে ঋতুরাজ বসন্ত এসে গেল। যেন ফিরে এসেছে বাঙালীর হাজার বছরের সহজিয়া জীবন-দর্শন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার সমাপ্ত এবং একাত্তরের খুনি ধর্ম-পাষন্ডদের বিচার শুরু করে বাঙালি তার অতুলনীয় মনুষ্যত্ববোধকে নিজেদের জীবনে আবার ফিরিয়ে চেষ্টা করেছে । এই বার্তা বাংলার আকাশে বাতাসে, সবুজ জনপদে বিপুল মানুষের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন মানবতার লক্ষ কোকিল এক সংগে জেগে উঠে। ১৯৪৭ সনে মানবতার মৃত্যু হওয়ায় প্রকৃতির আত্বার সংগে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। তারপর মনুষ্যত্বহারা মানুষের তান্ডবলীলায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় চন্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ হাসন লালনের পূণ্যভুমি বাংলাদেশ। একদিকে যেমন আমাদের অতুলনীয় মানবিক মূল্যবোধগুলির অবক্ষয় হল অন্যদিকে ধ্বংসের মুখোমুখি হলো প্রানী ও উদ্ভিদ রক্ষাকারী প্রকৃতি। বাঙালীর আত্মশক্তির পুনরাবিস্কারের ফলে এখন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সংগে সামাজিক ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মানুষ ও প্রকৃতির স্বার্থেই গনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলিকে সার্থক করা আমাদের সকলের জন্য অত্যাবশ্যক। |
।।এই লেখাটি সম্পর্কে আপনার মতামত দিন।।