NYnews52.com a e-news paper in Bengali and English with video excerpts.
Logo: NYnews52.com

Back to Front Page

মুক্তচিন্তা


কিসের এতো কথা


বেলাল বেগ

একজন সোনার মানুষ দেখেছি

বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন, ‘‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’’ সোনার মানুষটি কি রকম? তিনি নিজে কি সোনার? নাকি সোনা তৈরির পরশপাথর? 'ক্ষ্যাপা’ হয়ে আমি বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি সে পরশপাথরের সন্ধানে। পেয়েছিও অনেক। কুঁড়িগ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খয়বর আলীর মা। উত্তর বঙ্গের রক্ত জমাটকরা শীতে একটি দোকানের বারান্দায় খাদ্যাভাবে মৃত্যুর শীতল গহ্বরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। উদ্ধার কর্মীরা তাঁকে বাঁচিয়ে তুললে, তাঁর সংগে কথা বলেছি। বাঙালীর শাশ্বত মা’র সুখদুঃখআনন্দর কত অফুরান কথা। তাঁর তিন মেয়েই স্বামী সংসার নিয়ে মোটামুটি খেয়ে পরে বেঁচে আছে। তাঁদের সংগে তিনি থাকবেন না। শ্বশুড়-শাশুড়ীরা জামাই বাড়ীতে থাকলে মেয়ের যে সন্মান বাঁচেনা। আরেকজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। কোনরকমে ভাড়ার টাকা যোগাড় করে ঢাকা শহরে এসেছিলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুটি সোমত্ত মেয়ের সন্ধানে। একজনের সন্ধান পেয়েছেন অনেক ঘোরাঘুরি করে। বড়লোকের বাড়ীতে কাজ করে। ওদের ওখানেই ক’দিন পরে এই প্রথম পেট পূরে খাওয়া হয়েছে। অন্যজনের দেখা পাননি। ভগ্নহৃদয়ে মানুষটি বাড়ী ফিরছে। ভাড়ার পুরো টাকাটা না থাকায় অভূক্ত ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে বাস থেকে নামিয়ে দিচ্ছিল বাসের লোকেরা। আমাদের বাঁধার মুখে পারেনি। পথে বাস থামলে কথা বলার সময় তাঁকে খাইয়ে দিয়েছিলাম। খেতে গিয়ে অস্ত্রুসজল ঘোলাটে চোখে সে কি কুন্ঠা! আরেক জন রিকশাওয়ালা। বলল, দিনে নিরাপদে চলাফেরা আর রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর আশ্বাস দিলে সরকারের কাছে চাওয়ার কিছু থাকে না খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। দৈনিক প্রথম আলোর পৃষ্ঠপোষকতায় সারা বাংলাদেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে এ রকম অসংখ্য সোনার মানুষ দেখেছি বাংলার পথে ঘাটে। কিন্তু চুম্বক হিসাবে ওরা খুবই দুর্বল। তাদের পরশ কোন কাজে লাগেনা এই পোড়া দেশে। তাই শক্তিশালী পরশপাথরের সন্ধান করছিলাম। পেয়েছিও কিছু। তবে ১ বিলিয়ন সমস্যাযুক্ত ১৬০ মিলিয়ন মানুষের মঙ্গলের জন্য এই ক'জন মানুষ কিই বা করতে পারে? তাই আমার সন্ধান চলছে ত চলছেই।
সেদিন ২১ এপ্রিল, জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ মিশনে আরেকজন সোনার মানুষের সন্ধান পেলাম। জীবনে তাঁকে এই প্রথম দেখলাম। হাত মেলালাম। তাঁর কথা শুনলাম। শুনে বুঝলাম, জানলাম, তিনি মাটির মানুষ, জনতার লোক, জনতার নেতা।
তাঁর গায়ের রঙে, চেহারায়, মুখের ভাষায়, বলার ধরনে, পোষাকে, মানুষের সংগে মেলামেশায়, আচার-ব্যবহারে তিনি অবিকল সাধারন মানুষ। তাঁকে কবির মত প্রচার করতে হয় না ‘‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদের লোক’’--কিশোরগঞ্জের প্রতিটি মানুষের মত আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষও জানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার, আবদুল হামিদ তাদের লোক, তাদেরই একজন।
তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে আগত পাঁচ সদস্যের একটি পার্লমেন্টারী দল বাংলাদেশ মিশন ও প্রবাসী বাঙালী ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোগক্তা সংগঠনের যৌথ প্রয়াসে আয়োজিত উন্নয়ন ও গনতন্ত্র শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিচ্ছিল। তিনি ছিলেন প্রধান বক্তা। সাদামাটা কথায় আসল ও দামী কথাগুলই বললেন। বললেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্যে কঠোরহস্তে দূর্নীতি বন্ধ করতে হবে, আইন-শৃঙ্খলার সঠিক প্রয়োগ হতে হবে এবং বিরোধী দলকে সরকারের কাজের উপযুক্ত সমালোচনা করতে হবে। কেতাবী বক্তৃতা না করে তাঁর সহজাত মেঠোভাষায় তিনি বললেন, অতীতের ব্যর্থতা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহে আজ যে সংকট তৈরি করেছে, অতি দ্রুত তা মোকাবেলা করতে হবে সরকারকে। যে কোন মূল্যে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পেতেই হবে। আরো অনেকগুলি দরকারী কথা বললেন জনগনের নির্বাচিত নেতাদের নেতা স্পীকার আবদুল হামিদ। কথার মধ্যে কাজের কথার বাইরে কোন কচকচানি নেই। শেষে আবার বললেন বিরোধী দল সরকারের অংশ, সরকারের ভুল-ভ্রান্তির বিরোধীতা তাঁদের করতেই হবে। এ জন্যে বিরোধী দল যেন তাঁদের কথা বলতে পারেন, সেদিকে তিনি অত্যন্ত সজাগ থাকেন বলে জানালেন। তিনি জানালেন তাঁর ক্ষমতাকালে বিরোধী দলকে কথা না বলতে দেবার কোন ঘটনাই ঘটেনি। এমন কি সম্প্রতি বিরোধী দলনেত্রী প্রধান মন্ত্রীর চেয়েও বেশি সময় ধরে বক্তব্য রেখেছেন। সবশেষে তিনি তাঁর গ্রামের ভাষায় এবং স্বভাবজাত কৌতুকপ্রিয় ঢংয়ে দেশে বিনিয়োগের জন্য প্রবাসীদের প্রতি আবেদন জানান। বললেন, ‘‘আপনারা ত দেশে টাকা পঠানই; এরপর যখন পাঠাবেন এই যে আমরা পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্য এসেছি, আমাদের প্রত্যেকের জন্য একটা করে ডলার বেশি পাঠাবেন, এটা আপনাদের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন।’’ বিদেশে বর্তমানে ৭০ লক্ষ বাঙালী আছে। এক ডলার বেশি পাঠালে দেশে ৭০ লক্ষ ডলার বেশি যাবে। বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্ব সাধারণ মানুষের অন্তরে ঠাঁই করে দেবার কি অসাধারণ সাধারণ কথা।
স্বাধীনতার পর কয়েক যুগ বাংলাদেশে সামরিক একনায়কত্ব বহাল ছিল। ১৯৯১ সালে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র চালু হয়। এ ধরনের সরকারে পার্লামেন্টই জনগণের শক্তির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নানা রাজনৈতিক ও আদর্শিক সংঘাতের কারণে কোন পার্লমেন্টই তেমন সফল হয়নি। ফলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা এখনো একটি প্রধান সংগ্রাম হয়ে আছে। প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় অশোভন বাক-বিতণ্ডা অধিবেশন বর্জনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনই এক ‘মাছের বাজার’ অধিবেশনে সংসদ ও সাংসদদের সন্মান ও মর্যাদা রক্ষায় স্পীকার আবদুল হামিদ এমন হৃদয়-নিংড়ানো এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দেন যে তাতে সরকার ও বিরোধী দলের সকল সদস্যই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। সেই থেকে জাতীয় সংসদ আর তেমন একটা মাছের বাজার হয়নি। আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রে এটি একটি বিরাট, সুদূর প্রসারী ঐতিহাসিক অর্জন। স্পীকার হামিদের ন্যায়বোধ ও নিরপেক্ষতা বর্তমান সংসদ ও সাংসদদের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
এ সাধারণ মানুষটি সোনার মানুষ হয়েছেন মানুষের জন্য অবিরাম সংগ্রামের আগুনে পুড়ে পুড়ে। বাঙালীদের স্বার্থে রাজনীতির কারণে দু'বার পাকিস্তান আমলে ও একবার জিয়াউর রহমানের সময়ে জেলে গিয়েছিলেন। তিনি অসংখ্য সামাজিক সংগঠনের সংগে জড়িত। জনগনণর সুখদুঃখে অবিচ্ছদ্য আছেন বলে বাংলাদেশের পার্লমেন্টেও তাঁর আসন প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে আছে। জনতার মানুষ জনতার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন এটা আমাদের মহাভাগ্য।





Contact Us