মুক্তচিন্তা |
মুক্তচিন্তা কিসের এতো কথা বেলাল বেগযুদ্ধাপরাধীদের বিচাররবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার অভিশাপ’ শীর্ষক কবিতায় আমরা এক তীর্থযাত্রী মায়ের সাক্ষাৎ পাই। কষ্টসাধ্য এ তীর্থ যাত্রালগ্নে সংগে যেতে ছোট ছেলেটি নাছোড় বায়না ধরে । নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে মা। ছেলেটি ট্যাঁ ট্যাঁ করতেই থাকে। অতীষ্ট মা অবশেষে দেবতার অভিশাপ চেয়ে ছেলেটিকে সংগে নিতে বাধ্য হয়। নদীপথে যাত্রার এক সময়ে ঝড়ে নৌকাডুবিতে ছেলেটির সলিল সমাধি হয়। মা তখন দেবতাকে তিরস্কার জানিয়ে বলে, এ তুমি কেমন দেবতা যে মায়ের মন বুঝ না। বাংলাদেশে ‘যুদ্ধাপরাধ’ নিয়ে এত কি কথা! দেবতা কি জানে না বাংলাদেশে নির্বিচারে গনহত্যা হয়েছে? বাংলাদেশের আনাচেকানাচে গনকবরে অগণিত মানুষের কঙ্কাল দেশমাতৃকার বুকে শুয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, মাঠেঘাটে বনেবাদাড়ে পড়ে থাকা অসংখ্য মানুষের খুলি, হাড়গোড় জীবন্ত মানুষের বুকে সুঁই খুঁচিয়ে আজও বলে চলেছে, ও ভাই বাঙালি! তোমরা যারা বেঁচে আছ, বলোত দেখি আমাদের কি বাঁচার অধিকার ছিলনা? যারা মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন, দাদা, দাদী, নানা, নানী, চাচা, চাচী, মামা, মামী, খালা, খালু, ভাগ্নে, ভাগ্নী, ভাতিজা, ভাতিজী হারিয়েছে, তাদের হƒদয়ের ক্ষত আজও দগদগে আছে। কিন্তু মানুষের অন্তরের বেদনা বোঝার ক্ষমতা পশুদের থাকেনা। পশু হিংস্ত্র হয়ে উঠলে তাই ওটিকে হত্যা করতে হয়। একাত্তরে শান্তিপ্রিয় বাঙালীর হাতে অস্ত্র উঠেছিল পাকিস্তানী পশু হত্যার জন্য। এখনো প্রয়োজনে মনুষ¦ত্ব রক্ষায় বাঙালি স্বদেশ-বিদেশের যে কোন হিংস্ত্র পশু হত্যা করবে। কারন একটিই- বাঙালির কাছে মনুষ্যত্বই একমাত্র সত্য : ‘‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’’। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি মানবতাবাদ। হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম, এ তিনটি ধর্মের নির্যাস বাঙালির মানবতাবোধকে আরো শক্তিশালী, দৃঢ় ও ঐশ্চর্যময় করেছে। বাঙালির জাতীয় চরিত্রের এ হীরকখন্ডটি বৃটিশ জাতি অন্ধকারে চাপা দিয়ে রেখেছিল দু’শ বছর। ১৯৫২ সনে ভাষা আন্দোলনের অলৌকিক ছটায় কালের অন্ধকার কেটে গেলে বাঙালি-স্বত্ত্বা ‘নির্জরের স্বপ্নভঙ্গ’র মত আবার জেগে উঠে। সমান মানবিক মর্যাদায় জেগে উঠার এক পর্যায়ে স্বাধিন সর্ববৌম রাষ্ট্র হয়েছে বাঙালির। কিন্তু সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার ও মানবিক মর্যাদা এখনও চিরস্থায়ী করা যায়নি। সুতরাং আমরা গাইতেই থাকব সেকান্দর আবু জাফরের লেখা গনসংগীত ‘‘ জনতার সংগ্রাম চলবে; আমাদের সংগ্রাম চলবে, চলবেই ’’। বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হত্যার বিচার হওয়ায়, স্বাধীনতার এত বছর পরে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। মানুষের অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এটি বিশাল হলেও সম্পূর্ন অর্জন নয়। একাত্তরে ধর্ম-রাজনীতির যে অস্ত্র ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, এখনো সে অস্ত্র এবং তার ব্যবহারকারী বাহিনীকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও এখনো নিরাপদ নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ধর্ম-রাজনীতি ও তার ব্যবহারকারী হিংস্ত্র পশুদের নির্মূল করার একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। এটি দেশে সূচিত আইনের শাসনের বিষয়টিকে চূড়ান্ত করে বাঙালীর জীবনে একটি শ্বাশ্বত ধারা রচনা করবে। মুজিব হত্যার বিচারের সংগে সংগে যেমন ১৯৫২ সনে নবজন্মলভিত এবং বিশ্বাসঘাতক জিয়ার হাতে ছুরিকাহত হওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফিরে এসেছে, তেমনই প্রচন্ড শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে একাত্তরের চেতনা যা ধারন করার অক্ষমতা দেখিয়েছিল স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার। বর্তমান সরকার যে মুজিব হত্যার বিচার করতে পারবে, এমন কোন ধারণা স্বাধীনতাবিরোধী জামাত এবং বিকল্প মুসলিম লীগ- বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনে ঘুনাক্ষরেও ঠাঁই পায়নি। এখন তার বিচার হওয়ায় তাদের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। সরকারের শক্তি তাদের হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়েছে। তাই, মুজিব হত্যায় জড়িত ষড়যন্ত্রকারীরা যেমন তার বিচার ঠেকাতে আকাশ-পাতাল হাতরিয়ে উপায় খুঁজে বেড়িয়েছে, তেমনি প্রানভয়ে একাত্তরের ধর্মরাক্ষসগুলি এখন প্রাণপণে ছোটাছুটি শুরু করেছে। আইনের জালে তারা ধরা পড়বেই এবং যা হবার তা হবেই। জামাতের চেয়ে বেশি বিপদ দেখা দিয়েছে অন্যদের যারা একাত্তরের ঐ ধর্মরাক্ষসদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে রক্তার্জিত বাংলাদেশে আবার সেঁদিয়ে দিয়েছে। আহা বিএনপির বেচারারা! বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ্বাসঘাতক জিয়াউর রহমান একাত্তরের ধর্মদানবদের রক্ষা করার জন্যই যে বিএনপি নামক দল করেছিল অধিকাংশ সরল বিশ্বাসী বিএনপি-সদস্য তা কখনই জানার অবকাশ পায়নি। তথাকথিত চীন-পন্থি, বেকুব, রাজনীতিকগুলি যারা বিপ্লবের ফেনসিডিল খেয়ে জিয়ার দলে ভীড়েছিল, দৈবক্রমে আগে আগে সরে গিয়ে তারা এ যাত্রা বেঁচে যাবে। কিন্তু জনতার আদালতে ফাঁসতে হবে সাকাচৌ সাঙ্গ্যাৎদের এবং বিএনপির অভ্যন্তরে জামাতের অতিচালাক অনুচরদের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সোচ্চার হয়ে গনধিক্কার থেকে বেঁচে থাকার এখনো সুযোগ আছে তাদের, যারা ন্যাপের প্র: মোযাফফর কিংবা এ লেখকের মত শুরুতে জিয়া-কুহকে ধোকা খেয়ে জিয়াকে ত্রাণকর্তা ভেবেছিলেন। আপনি যদি বাঙালি হ’ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পানি ঘোলাটেকারীদের সনাক্ত করুন এবং সতর্ক থাকুন। আপনাদের ভেবে দেখতে হবে, জামাতের চিহ্নিত খুনীরা কেন জোরগলায় দাবী করছে কেউ তাদের বিচার করতে পারবে না। তাদের আশ্রয় দাতারাও বা কেন বলছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকার দোদুল্যমান। এটা একটি ধূম্রজাল। খুবই চালাকি করে তারা চায় সরকার যেন যুদ্ধাপরাধ হিসাবেই মামলাগুলিকে দেখে। সরকার যদি এ ফাঁদে পা দেয়, তাহলে মামলাগুলি আদতেই দাঁড়াবেনা কারন ঘোষিত যুদ্ধটা হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এবং সিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিষয়গুলির নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে। সরকার ঐ ফাঁদে পা না দিয়ে মানবতাবিরোধী হিসাবেই একাত্তরের খুনীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। সুতরাং আইনের মুখে একাত্তরের খুনীরা ছুঁচোর মত ধরা পড়েছে। তাদের নিস্তার নেই। মুক্তমনা এখানে ক্লিক করুন |
Contact Us