Back to Front Page |
ফিল্ম রিভিউ অরণ্যLandscape in the Mist -1988Theodoros Angelopoulos ১৯৯০-এর কোলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে যে দুটো ছবি সবচে’ বেশি প্রশংসিত হয়, তার মধ্যে একটি ছিল 'থিও অ্যাঞ্জিওপুলাস’-এর 'ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ ছবিটি, এবং সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় নিজেও ছবিটি সম্পর্কে খুব উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন, এবং এর প্রধান দুই শিশু চরিত্রকে আখ্যায়িত করেছিলেন, গ্রীসের 'অপু-দুর্গা’ বলে। 'পথের পাঁচালী’ আমিও দেখেছি, এবং বিশ্ব র্যাংকিংয়ের উপরের দিকে থাকা হাজারের অধিক ছবি সংগ্রহ শেষে আমার নিজস্ব মত এই, বিশ্ব চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালী’র মত অসাধারণ সেলুলয়েড নির্মাণ আর দু’টি পাবে না, এবং এই একটিমাত্র ছবির জন্যই সত্যজিৎ রায় বছরের পর বছর বেঁচে থাকবেন চলচ্চিত্র প্রেমিদের মনে। কিন্তু, তারপরও যখন আমি 'থিও অ্যাঞ্জিওপুলাসের’ এই ছবিটা দেখছিলাম, তখন কেন জানি মনে হচ্ছিল, কিছু কিছু সৃষ্টিকে কখনোই অন্য কারো সাথে তুলনা করা যায়না, তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানে স্ব স্ব মহিমায় মহান। ১৯৮৮ সালে গ্রীসে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২৭ মিনিট দৈর্ঘ্যর এ ছবিটি সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচকদের নানাবিধ মত থাকলেও, এই বিষয়ে হয়ত সবাই শেষ পর্যন্ত একমত হবেন, এর নির্মাণ শৈলী যেন ছবিটির অন্যান্য সব দিককেই ছাড়িয়ে গেছে। পুরো ছবি জুড়ে কুয়াশাঘেরা, শান্ত, এমন একটা বাতাবরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেন ছবি নয়, বরং চলমান কোন বিশাল ল্যান্ডস্কেপের সামনে দর্শক হিসেবে আমরা বসে থাকি নির্বাক, কারো মুখে কোন শব্দ নেই, আর সেই নিঃস্তব্ধতা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে, যখন পর্দার ওপার থেকে পাঁচ বছর বয়সী আলেকজান্ডার ও বারো বছরের ভুলার, মনে মনে তাদের বাবাকে লেখা চিঠির এই লাইনগুলো ভেসে আসে, যার সাথে মিশতে থাকে ট্রেন চলার মৃদু শব্দ, "প্রিয় বাবা, তোমাকে লিখছি কারণ আমরা তোমার কাছে আসতে এবং তোমাকে দেখতে চাই। আমরা কখনোই তোমাকে দেখিনি এবং তোমাকে আমাদের দরকার। আমরা সবসময় তোমার কথা বলাবলি করি। আমাদের এই পালিয়ে যাওয়ায় মা কষ্ট পাবেন, কিন্তু ভেবোনা তা আমাদের থামাতে পারবে, এবং তারপরও সে বুঝে উঠতে পারবে না। আমরা জানিনা তুমি দেখতে কেমন। আলেকজান্ডার তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। সে তার স্বপ্নে তোমাকে দেখে। তোমাকে আমাদের খুব দরকার। যখন আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি, তখন পেছনে তোমার পায়ের শব্দ শুনি, কিন্তু যখন ফিরে তাকাই, তখন সেখানে কেউ থাকেনা, ফলে আমার প্রচণ্ড একাকী বোধ হয়। আমরা তোমার বোঝা হতে চাইনা, শুধু তোমাকে দেখতে চাই, এবং তারপর ফিরে আসব। যদি তুমি আমাদের উত্তর দিতে চাও, তাহলে ট্রেনের এই শব্দের সাথে দাও, টা-টান, টা-টান, টা-টান...” না, এটা ছবির শুরু নয়, তবে ছবি শুরুর কিছুক্ষণ পরের দৃশ্য, এবং সন্তানের অবৈধতার পরিচয় লুকোতে মায়ের বলা মিথ্যাতে, 'যে তাদের বাবা জার্মানীতে থাকে’, দুই শিশু বেরিয়ে পড়ে তাদের বাবার খোঁজে, যারা রোজ রাতে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে দেখে জার্মানী যাওয়ার ট্রেন কিভাবে তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়, যেনবা এই ট্রেনটাই একমাত্র উপায় তাদের প্রিয় বাবার সাথে মিলিত হবার। প্রত্যেকবার-ই তারা স্টেশনে আসে এবং চেষ্টা করে ট্রেনে ওঠার, কিন্তু পারেনা, এবং শেষ পর্যন্ত যখন উঠে পড়ে, তখন চলমান ট্রেনের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে, "আমরা পেরেছি” বলে আনন্দে দু’ভাইবোনের একে অপরকে জড়িয়ে ধরায় যে খুশির রেশ ছড়িয়ে পড়ে, তা দর্শক হিসেবে আমাদের মনকেও দোলা দিয়ে যায় যেমন, তেমনি চলমান ট্রেনের মৃদু শব্দে মনে মনে বাবাকে লেখা ভুলা বা আলেকজান্ডারের চিঠির প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, আমাদের বিমূঢ়, উদাস ও দুখি করে তোলে। বস্তুত, ছবিতে মনে মনে বাবাকে লেখা ওদের চিঠিগুলোকে আমার একেকটা হৃদয় বিদারক কবিতা মনে হয়েছে, এবং যখন ভুলা তার চিঠিতে বাবাকে জানায়, যে 'আলেকজান্ডার নাকি তাকে প্রায় স্বপ্নে দেখে, এবং তার সম্পর্কে নানারকম কথা বলে’, তখন কোথা থেকে কিছু জল এসে চোখের কোণে জমা হয়। তাছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পুরো ছবি জুড়েই দর্শক মনে তার প্রতিক্রিয়া আলাদা ভাবে জাগাতে সক্ষম হয়। ছবিতে এমনকিছু দৃশ্য আছে যেগুলো না চাইলেও মনের ভেতরে গেঁথে যায়, এবং একটা তীব্র কম্পন হৃদয়ের কোন না কোন কোঠরে টের পাওয়া যায়। যেমন রাতের বেলা বিবাহ পরবর্তী অনুষ্ঠানে মত্ত একটা বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসা হৈ-হুল্লোড় এবং গানবাজনার আওয়াজ শুনে দু’ভাইবোন সেখানে দাঁড়ায়, এবং কেউ একটা মুমূর্ষ ঘোড়াকে ট্রাক্টর দিয়ে টেনে বরফের উপর রেখে গেলে, ওরা ঘোড়াটির কাছে ছুটে আসে। ভুলা ঘোড়াটির শরীরে হাত বুলায়, আর আলেকজান্ডার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন ভুলা তার ভাইকে জানায় যে ঘোড়াটি মারা যাচ্ছে, তখন বোন ও মুমূর্ষু ঘোড়াটির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলেকজান্ডারের যে নিষ্পাপ কান্না, এবং পেছনে বিবাহ পরবর্তী গান-বাজনায় মত্ত মানুষের দল বেঁধে ফিরে যাওয়া, তাতে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, মনে হয় বিশ্বমানবতার নিভৃত কান্না আলেকজান্ডারের কান্নার স্বরে ভেসে এসে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের মর্মমূলে। কিংবা লরির ড্রাইভার জোর করে ভুলাকে ধর্ষণ করলে, সে লরির ভেতরে থেকে বেরিয়ে এসে যখন বাইরে পা ঝুলিয়ে বসে, তখন তার দু’পায়ের ফাঁক বেয়ে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত, যা দিয়ে সে লরির দেয়ালে আঁকিবুকি করে, তখন আমাদের কারোরই কোন মুখোশ থাকেনা, কারণ ওই নিষ্পাপ হাতে লেগে থাকা লাল তরল তার অমোচনীয় দাগ এঁকে দিয়ে যায় সভ্যতার নির্মম দেয়ালে। আমরা চমকে উঠি, এবং বিবশ একটা বোধে ঢুকে পড়ি নিজেদের আরও গভীরে। এমন বেশ কিছু অনন্যসাধারণ দৃশ্য আমরা দেখতে পাই পুরো ছবি জুড়ে। যেমন হঠাৎ তুষারপাত শুরু হলে শহরের লোকজনের পাথরের মূর্তির মত তুষাপাতের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার যে দৃশ্য অ্যাঞ্জিওপুলাস চিত্রায়ন করেছেন, তাতে দর্শক সারি থেকে উঠে গিয়ে ওই তুষারপাতের নিচে আমাদেরও দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিংবা রাতের নদী পার হয়ে পরবর্তী সকালে ঘন কুয়াশায় ঢাকা সাদা স্ক্রিনের ওপার থেকে আলেকজান্ডার যখন বোন ভুলাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য ডাকে, "ওঠো, এখন ভোর, আমরা জার্মানীতে পৌঁছে গেছি," তখন স্ক্রিনের সামনে বসে থাকা আমাদেরও যেন ঘুম ভাঙে, এবং ঘন কুয়াশা ভেদ করে দুই ভাইবোনের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে যেতে খোলা প্রান্তরে আবিষ্কার করি একটা গাছ। ওদেরই মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশঃ গাছটি স্পষ্ট হয়ে উঠলে, ওদের সাথে সাথে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি গাছটিকে। এছাড়াও ছবিটির যে দৃশ্যর কথা না বললেই নয়, সেটা হল সমুদ্র তীরে বসে থাকা নায়ক 'অস্টিসের’ সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠা বিশাল একটা হাত, যেটাকে হেলিকপ্টার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও দৃশ্যটা ফেলিনির 'লা দোলচে ভিটা’র হেলিকপ্টারে ঝোলানো যিশু মূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু দৃশ্য দু’টির চিত্রায়নের যে বিশাল পার্থক্য, তা যে কোন সাধারণ দর্শকেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়না। আর ছবিতে ভ্রাম্যমান নাট্যদলের উপস্থিতিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও অ্যাঞ্জিওপুলাসের আরেক ছবি, 'দি ট্রাভেলিং প্লেয়ারেও’ অনুরূপ নাট্যদলের উপস্থিতি আমি দেখেছি, তবুও এই ছবিতে ভ্রাম্যমান নাট্যদলের উপস্থিতি পুনরাবৃত্তি মনে না হয়ে, নতুন মনে হয়েছে। দু’ঘন্টা সাত মিনিট ধরে প্রাণের উপরে ছেয়ে থাকা একটা অন্যরকম ঘোর যেমন কাটিয়ে উঠতে পারিনা, তেমনি পারিনা ছবি শেষ হয়ে যাবার পরও গাছকে আলিঙ্গনরত ভাইবোনের উচ্ছ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতে। পুরো ছবিতে আমার কোথাও একটিবারের জন্যও মনে হয়নি বিন্দুমাত্র অতিরিক্ত শব্দ রয়েছে, বরং একটা অন্যরকম স্তব্ধতা যেন সবসময় ঝরে পড়েছে ছবি জুড়ে। যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "এ সেই ব্রহ্মাণ্ডহারা নিঃসঙ্গ গ্রহের ছবি, যা কোন সূর্যশাসিত নয়। বস্তুত, ছবিতে বারেকের জন্যও, সূর্য ওঠেনি। বা, অস্ত যায়নি। কোনো চরিত্রের ছায়াই পড়েনি কখনো, এ ছবিতে। সূর্য যদি উঠে থাকে, তার উদয় হয়েছিল মধ্যরাতে। মধ্যরাত্রির সূর্যের ম্রিয়মান আলো সারাক্ষণ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ছবিটির, আহা, সর্বাঙ্গে।” এর চেয়ে ভালো এই ছবি সম্পর্কে আর কিছুই বলা যায়না। খুব কম ছবিই থাকে থাকে যেগুলো বার বার দেখা যায়। 'ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ তেমনি একটা ছবি, যেটা শুধু বার বার নয়, অজস্রবার দেখা যায়, এবং যে কোন দ্বীপান্তরের সঙ্গী হিসেবে প্রিয় কোন বইয়ের মত, অনায়াসেই একমাত্র কাম্য হয়ে উঠতে পারে এই ছবি। |
Contact Us